বাসাবাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্র; ফুটপাত থেকে যানবাহন—কোথাও নারীর নিরাপত্তা নেই। হাঁটতে-বসতে অযাচিত স্পর্শ এড়িয়ে চলা তাদের পক্ষে প্রায়-অসম্ভব। বিশেষত যেখানে ভিড়, সেখানেই বখাটের অযাচিত স্পর্শের আতঙ্কে নারীকে থাকতে হয়। সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হতে হয় গণপরিবহনে। বেশির ভাগ গণপরিবহনই সিট-ক্যাপাসিটির বাইরে যাত্রী তোলে। এতে প্রায় অর্ধেক যাত্রী বসার সিট পান না। তারা দাঁড়িয়েই গন্তেব্যে যেতে বাধ্য হন। এরই সুযোগ নেয় কতিপয় বখাটে। ভিড়ের ভেতর অধিকাংশ নারীই প্রতিবাদের সুযোগ পান না।
এরপরই আছে কর্মক্ষেত্র। সেখানে ঊর্ধ্বতনের লালসার শিকার হতে হয় নারীকে। গণপরিবহনে প্রতিবাদের সুযোগ কালেভদ্রে মিললেও কর্মক্ষেত্রে প্রতিবাদের ফল শুভ হয় না। চাকরিচ্যুত হওয়া ছাড়াও নারীর চরিত্রে কলঙ্কের দাগ চিরদিনের জন্যই লেপনের আশঙ্কা থেকে যায়। নারীকে সারাক্ষণই সন্ত্রস্ত হয়ে চলতে হয়।
কর্মস্থল, পথে-ফুটপাতে ও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তায় জরুরি ভিত্তিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে, এসব পদক্ষেপ কেবল কাগজে-কলমে লিপিবদ্ধ থাকলে চলবে না, এগুলো বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সচেষ্ট হতে হবে। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না—দেশে প্রচলিত শিক্ষার সঙ্গে মনুষত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। ফলে সনদধারী শিক্ষিতের হার যত বাড়ছে, ততটা সংস্কৃতিবান বাড়ছে না। সমাজে বৈষয়িক ও ক্যারিয়ারভিত্তিক উন্নতির প্রতিযোগিতা তীব্র হচ্ছে। চাকরির জন্য লাখ লাখ তরুণ প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মানবিক হয়ে উঠছে না। মানবিকতার চেয়ে চাতুর্যই বড় হয়ে উঠছে। এসব ঘটনায় লজ্জায়-অপমানে-বিচারহীনতায়-সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় নারীরা আত্মহত্যার দিকেই ধাবিত হচ্ছে। তবু বন্ধ হচ্ছে না ধর্ষণ-যৌন-হয়রানির মতো ঘৃণ্য কর্ম। বরং দিনে দিনে ‘দুঃশাসন’রা দ্রৌপদীদের বস্ত্রহরণের উন্মত্ত প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার পেছনে কী কারণ রয়েছে, তার রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য সমাজবিজ্ঞানী ও মনস্তত্ত্ববিদরা গবেষণা করতে পারেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ সেই গবেষণালব্ধ প্রতিবেদনের আগে এমন অর্ধম-যৌন-হয়রানির প্রতিকার চায়। তাদের কাছে তাত্ত্বিক গবেষণার মূল্য সামান্যই। এর চেয়ে ব্যবহারের প্রমাণের গুরুত্ব বেশি। তাই সাধারণ মানুষ চায়, নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে রাষ্ট্রকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
যৌন হয়রানি প্রতিরোধে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সেগুলো হলো:
১। গণপরিবহনে নারীর জন্য অর্ধেক আসন বরাদ্দ করা
২। কর্মস্থল-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ সেল গঠন
৩। কর্মস্থল-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিসি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা। থাকতে হবে কার্যকর পদক্ষেপও
৪। পথে-ফুটপাতে পুলিশের নজরদারি
৫। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা
দেশের মোট জনগোষ্ঠী তো বটেই, কর্মজীবীদেরও প্রায় অর্ধেক নারী। তাই কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায়, গণপরিবহনে অর্ধেক নারী হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাদের চলাচলের জন্যও গণপরিবহনে অর্ধেক আসন বরাদ্দ করা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, তা নেই। এর ওপর আছে সিট ক্যাপাসিটির দ্বিগুণ যাত্রী বহনের বিষয়ও। ফলে গণপরিবহনে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। মূলত এই সুযোগে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাগুলোর জন্ম। আর বিকৃত রুচির পুরুষদের লালসার শিকার হতে হয় নারীকে। চলতি বছরের ৫ মার্চ বেসরকারি সংস্থা আঁচলের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, গণপরিবহনে ৪৫ শতাংশ নারী যৌন-হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ভিড়ের ভেতর কে কার সঙ্গে কী ধরনের বিকৃত আচরণ করছে, অনেক সময় তা শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। এই সংকট নিরসনে গণপরিবহনে নারীর জন্য অর্ধেক আসন বরাদ্দের পাশাপাশি সিট ক্যাপাসিটির বাইরে যাত্রী না তোলার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীদের ধর্ম—যেকোনো খাত থেকেই শতভাগ মুনাফা আশা করা। তারা অন্যান্য বাণিজ্যিক খাতের মতো গণপরিবহন থেকেও ঝুঁকিমুক্ত মুনাফা প্রত্যাশা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সচেতন মহল ও সরকারকে মনে রাখতে হবে—গণপরিবহন যতটা বাণিজ্যিক, তারও বেশি সেবাখাত। এ কারণে আগে সেবা শতভাগ নিশ্চিত করে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে।
গণপরিবহনে সিটক্যাপাসিটি অনুযায়ী যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি নারীর জন্য অর্ধেক আসন বরাদ্দ করলে যৌন হয়রানির ঘটনা ১-২ শতাংশে নেমে আসতে বাধ্য। কারণ, যে আসন অনুযায়ী অর্ধেক নারী বাকি আসনে পুরুষ বসলে সেখানে কেউ তার লালসা চরিতার্থ করার ধৃষ্টতা দেখানোর সাহস পাবে না।
গণপরিবহনের পরই আসে নারীর কর্মস্থল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অধিকাংশ কর্মস্থলে ঊর্ধ্বতন ও শিক্ষকের হাতে নারীরা যৌনহয়রানির শিকার হচ্ছেন। কীভাবে হচ্ছেন—সেই তথ্য সবসময় জনগণের সামনে আসছে না। এর কারণও রয়েছে—পুরুষ ঊর্ধ্বতন ও সহকর্মীরা প্রায় ছবি তোলার ছলে, নানা অনুষ্ঠানে কর্মসম্পাদনের ছলে নারী বাহু- গ্রীবা-কোমরসহ সংবেদনশীল অঙ্গ স্পর্শ করার ধৃষ্টতা দেখান। এমনকি এই সময় নারীরা বিব্রত হলে পুরুষ সহকর্মীরা এমন আচরণ করেন, যেন নারীরা পশ্চাদপদ, তারা প্রগতিপরিপন্থী। এমন স্পর্শেই তাদের জীবন ধন্য হয়ে যাবে। না হয় তাদের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। আর এসব ঘটনায় অভিযোগ করেও প্রায় প্রতিকার মেলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাক্ষীর অভাবে অভিযোগ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। এই সংকট নিরসনের একটি মোক্ষম উপায় হতে পারে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে করপোরেট প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিসে সিসি ক্যামেরা থাকলে প্রতিকারের ব্যবস্থা সহজ হবে। অভিযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিসি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে প্রকৃত ঘটনা জানার সুযোগ ঘটবে। আর সার্বক্ষণিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকলে কর্তৃপক্ষের নজরে অপ্রীতিকর ঘটনা স্বাভাবিকভাবেই ধরা পড়বে।
সিসি ক্যামেরা স্থাপনের পাশাপাশি কর্মস্থল-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিশেষ সেল গঠন করতে হবে। যে সেলের কাজ হবে অভিযোগ পাওয়ার পর সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করা। একইসঙ্গে অভিযোগকারী, অভিযুক্ত ও অন্যান্য ব্যক্তির বক্তব্য শোনা, বিশ্লেষণ করা। এরপর দ্রুত, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা। তাহলে অপরাধের পরিমাণ কমে আসবে।
নারীকে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়তে হয় পথে-ফুটপাতে। চলতে গেলে নানা রকম কটাক্ষের পাশাপাশি যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি ধর্ষণের ঘটনাও ঘটে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম সভ্য রাষ্ট্রে নারী স্বাধীনভাবে পথ চলবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নারীকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেয় না কতিপয় বিকৃত রুচির মানুষ। তারা কর্মস্থলে, গণপরিবহনে যেমন উৎপাত করে, তেমনি পথে-ফুটপাতেও ওত পেতে থাকে। সময়-সুযোগ পেলেই লালসা চরিতার্থ করে। এই অপরাধীচক্রকে দমন করতে হলে পথ-ফুটপাতের ওপর পুলিশি নজরদারি বাড়াতে হবে। যেখানে ঘটনা, সেখানেই পুলিশ। অপরাধীকে আটক করে দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করার জন্য পুলিশি নজরদারির বিকল্প নেই। যৌন-হয়রানি প্রতিরোধে পুলিশকে কাজে লাগাতে হবে। তাদের মধ্যে মানবিক গুণের চর্চা বাড়াতে হবে। কারণ অপরাধ দমনে যে পুলিশের সাহায্য নেবে জনগণ, যে পুলিশকেই আগে নিরাপদ হতে হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, পুলিশের হাতেই নারী নিরাপদ নয়। হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য ছোট-বড় অপরাধের পাশাপাশি যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ক্ষেত্রে পুলিশের জড়িত থাকার ঘটনাও কম নয়। তাই যৌনহয়রানি প্রতিরোধে দায়িত্ব দেওয়ার আগে, সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো যথাযথভাবে নিলে নারীর প্রতি অপরাধ কমে আসবে। কিন্তু ষোলো আনা বন্ধ হবে না। কারণ আইন করে অপরাধ সমূলে নির্মূল করা যায় না। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেবল আইন করে, শাস্তি দিয়ে অপরাধ দমন সম্ভব নয়। যৌন হয়রানির মতো অপরাধ তো নয়ই। এর কারণ শাস্তিকে মানুষ ভয় পায় সত্য, সেই ভয় আরোপিত। সেই ভয় তার প্রবৃত্তিকে দমন করতে পারে না। মানুষ যখন ক্রোধান্ধ হয়, কিংবা তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়, তখন আরোপিত ভয় তাকে স্পর্শ করতে পারে না। অপরাধ করলে তার পরিণতি কী হবে, এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধীরা ভাবে না। তারা চলে প্রবৃত্তির কুপ্ররোচনায়। আইনের শাস্তি তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে পারে না। আরও সহজ করে বললে বলতে হয়, আইন অপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে কেবল তখন, যখন কোনো ব্যক্তি অপরাধ করে এবং তা প্রমাণিত হয়। কিন্তু ‘অপরাধী মন’কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না কোনো আইন। এ জন্য মনের ভেতর অপরাধ করার বাসনা যেন স্থান না পায়, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে—প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। কিন্তু কী সেই ব্যবস্থা? সহজ উত্তর—সামাজিক আন্দোলন।
আমাদের নিশ্চয় মনে আছে, সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে ইতোপূর্বে জন্মনিয়ন্ত্রণ, সর্বজনীন শিক্ষা, অ্যাসিড বন্ধে সফলতা এসেছে। এছাড়া, যৌতুক প্রথা ও বাল্যবিয়েও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। সমাজে যত সচেতনতা বাড়বে, তত এই ধরনের অপরাধের পরিমাণ কমে আসবে।
যৌন হয়রানিসহ নারীর প্রতি যেকেনো ধরনের সহিংস আচরণ রোধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। নাটক, পথনাটক, যাত্রাপালা, মাহফিল, পালাগান, গণসংগীত, চিত্রকলা, জনসভা-সেমিনার, টকশো, কবিতা, গল্পের মাধ্যমে যৌন হয়রানিবিরোধী প্রচারণা চালাতে হবে। এসব অনুষ্ঠানে ধর্মীয় বক্তা, রাজনৈতিক নেতা, সাংস্কৃতিক-কর্মীরা যৌন হয়রানিবিরোধী বক্তব্য রাখবেন। তাদের বক্তব্যে যৌনহয়রানির কুফল সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে হবে। শুধু তা-ই নয়, নারীদেরও সোচ্চার হতে হবে। আত্মরক্ষার দায়িত্ব নারীর নিজেকেই নিতে হবে। আত্মরক্ষার স্বার্থে যেখানে অন্যায়-অধর্ম, সেখানেই তাদের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সেখানেই তাদের ছোবল দিতে হবে। ছোবল দেওয়া সম্ভব না হলে অন্তত ফোঁস করে উঠতে হবে। তাহলে একদিন সমাজ থেকে দূর হয়ে যাবে যৌন হয়রানির মতো ঘৃণ্য কর্ম। মানুষ নারীকে সম্মান দেবে, মায়ের মতো, বোনের মতো, কন্যার মতো। তারা নারীর সম্মান বাঁচানোর জন্য এগিয়ে আসবে—যেমন স্ত্রী-প্রেমিকার সম্মান বাঁচাতে প্রাণ বাজি রেখে এগিয়ে আসে প্রকৃত স্বামী-প্রেমিক।
লেখক: কবি-প্রাবন্ধিক-সাংবাদিক।