পুলিশ গুলি করল, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ল, লাঠিপেটা করল, মামলা করল; তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের পর একটা পর্যায়ে এসে তবু শিক্ষার্থীরা তাদের সামনে ফুল হাতে দাঁড়াল। হাঁটু গেঁড়ে পায়ের কাছে বসে বলল—‘পুলিশ তুমি ফুল নাও, আমার ক্যাম্পাস ছেড়ে দাও’। পুলিশ ফুল গ্রহণ করেনি। বিভিন্ন মাধ্যমে তাদের মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ার দৃশ্যটাই প্রকাশিত হলো। একজন শিক্ষক যখন আন্দোলনের বিরোধিতা করে অনুষ্ঠিত এক মানববন্ধনে গিয়ে বললেন—‘আমরা বুদ্ধিজীবী শ্রেণি ধারণ করি, আমরা চাষাভুষা নই যে, যা ইচ্ছা তা বলা যাবে’। জবাবে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘এলিট শ্রেণির’ দাবি না করে শেকড়কে সম্মান করে স্লোগান তুলল—‘চাষাভুষার সন্তান, আমরা সবাই সাস্টিয়ান’। ক্যাম্পাসেও গ্রাফিতিতে ভাসল চাষাভুষা-চিত্র, ভিসির পদত্যাগের দাবি।
পুলিশি হামলা, অপপ্রচার, আচার্য-সরকারের নির্বিকার ভাব, আলোচনার প্রস্তাবের নামে শিক্ষামন্ত্রীর কালক্ষেপণ, ভিডিয়ো কনফারেন্সে শিক্ষার্থীদের দাবি সত্ত্বেও উপাচার্যের পদত্যাগ নিয়ে মন্তব্য না করে আন্দোলনরতদের অনশন ভাঙার আহ্বান, অবরুদ্ধ ভিসির ছাত্র-আন্দোলনকে পাত্তা না দেওয়ার সবকিছু ঘটছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এতে কি সমস্যার সমাধান হয়েছে, হচ্ছে বা আদৌ হবে? মনে তো হয় না। বরং আন্দোলন আরও বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। একটা ছাত্রীহলের আন্দোলন পুরো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে এখন জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা দেশের গণমানুষের সমর্থন পাচ্ছে। দেশের অপরাপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সচেতন নাগরিকসমাজ শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সামনে আসছে ভিসি নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সরকার/সরকারগুলোর চিরায়ত অভিসন্ধি। কী যোগ্যতায় ভিসি নিয়োগ হয়ে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটাও সামনে আসছে।
ভিসি নিয়োগে গোমর ফাঁসের ঘটনা কি সরকারের ভাবমূর্তির ক্ষুণ্ণ করছে না? এর মাধ্যমে কি দেশবাসী বুঝতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে কাদের নিয়োগ দিয়ে আসছে সরকারগুলো? কী তাদের উদ্দেশ্য? কেন ছাত্র-আন্দোলন হয় বারবার বিশ্ববিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়ে? একাডেমিক-প্রশাসনিক যোগ্যতা, নাকি অন্য কিছু। অপ্রকাশ্য সত্যগুলো যত বেশি বেরিয়ে আসবে তত বেশি বিব্রত হতে হবে সরকারকে। এই বোধ কি সরকারের দায়িত্বশীলদের কারও মধ্যে আসছে না?
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদকে গত বছর দ্বিতীয়বারের মতো উপাচার্যের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী নীল দলের শিক্ষক ছিলেন। বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে তিনি ওই জোটপন্থী সাদা দলের শিক্ষক ছিলেন, এমন তথ্য বেরিয়েছে গণমাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জিয়া চেয়ার’ স্থাপনের প্রস্তাবক তিনি ছিলেন, এমন অভিযোগ ওঠেছে। তবু তিনি আওয়ামী লীগের প্রিয় একজন শিক্ষক, উপাচার্য।
রাজনীতির ময়দানে আমরা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতাদের মুখে ‘অনুপ্রবেশকারী’ শীর্ষক একটা শব্দ দীর্ঘদিন ধরে শুনে আসছি। বিএনপি, জামায়াত, হেফাজত, জাতীয় পার্টিসহ নানা দল থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে ত্যাগীদের কোণঠাসা করার অভিযোগ এই ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ বিরুদ্ধে। ত্যাগীরা এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করে, কিন্তু এমন অভিযোগ ও দাবির পরেও কখনও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বা সুযোগসুবিধা বন্ধ করে দেওয়ার নজির দেখা যায় না। ফলে আলোচিত অনুপ্রবেশকারীরাই সকল জায়গায় তাদের প্রভাব বিস্তার করে বসে আছে। শাবিপ্রবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ-বিএনপির শিক্ষক রাজনীতি করার যে ইতিহাস, তার পদায়ন এবং তাকে আগলে রাখতে সরকারের প্রাণান্ত যে প্রচেষ্টা তাতে করে অনুপ্রবেশকারীদের জয়জয়কারের ইঙ্গিত বহন করে।
শাবিপ্রবির এবারের ছাত্র-আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে যদি উল্লেখ করি তবে দেখা যায়, গত ১৩ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদ লিজার বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েকশ ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের দাবিকে পাত্তা দেননি উপাচার্য। ১৬ জানুয়ারি বিকেলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি ভবনে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করে। তখন শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা, গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে পুলিশ। এরপর পুলিশ ৩০০ জনকে আসামি করে শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মামলা করে। সেদিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থীরা তা উপেক্ষা করে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে তার পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে নামে।
এরইমধ্যে ছাত্রীহলের প্রাধ্যক্ষকে প্রত্যাহার করে নতুন প্রাধ্যক্ষ নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে পুলিশি হামলার ঘটনা ঘটে, তখন শিক্ষার্থীদের দাবি এক দফাতে নেমে আসে : উপাচার্যের পদত্যাগ। ১৯ জানুয়ারি পৌনে তিনটা থেকে উপাচার্যের পদত্যাগ না করা পর্যন্ত আমরণ অনশনে বসেন ২৪ শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে একজনের বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ায় তিনি অনশন শুরুর পরদিনই বাড়ি চলে যান। ২৩ জানুয়ারি আরও চারজন শিক্ষার্থী অনশনে যোগ দেন।
এর মাঝে উপাচার্য ইস্যুতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ২২ জানুয়ারি গভীর রাতে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন শিক্ষামন্ত্রী। বৈঠকে উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য না করলেও দাবিগুলো লিখিতভাবে জমা দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তবে বৈঠকের পর শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের মূল দাবি উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগ। এই দাবি না মানা পর্যন্ত তারা আন্দোলন থেকে সরবেন না। ২৩ জানুয়ারি দুপুরের পর শিক্ষার্থীদের আবার শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। শিক্ষামন্ত্রী সময় দেননি শিক্ষার্থীদের। ফলে তারা উপাচার্যকে অবরুদ্ধের ঘোষণা দেন।
শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে আমরণ অনশনে থেকে একের পর এক হাসপাতালে যাচ্ছে, মুমূর্ষু অবস্থায় রয়েছে অনেকেই। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন তারা, তবু খাবার গ্রহণ করছে না। এমন অবস্থাও শিক্ষামন্ত্রী নির্বিকার। তিনি শিক্ষার্থী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বার্থ না দেখে দেখছেন উপাচার্যের স্বার্থ। এই স্বার্থ ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক। অগণন শিক্ষার্থী মৃত্যুপথযাত্রী তবু সামান্য মানবিকতা স্পর্শ করতে পারছে না উপাচার্য, শিক্ষামন্ত্রী, সরকার ও আচার্যকে। তারা তাদের রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগকৃত উপাচার্যকে রক্ষায় মরিয়া। এদিকে শিক্ষার্থীরাও মরিয়া তাদের এক দফা দাবি আদায়ে। একদিকে প্রাণ যায় যাক, তবু উপাচার্যের পদত্যাগ; অন্যদিকেও তেমন প্রাণ গেলে যাক শিক্ষার্থীর, তবু উপাচার্য-রক্ষা। বিষয়টি সরকারের ইগো সঙ্কট হিসেবে দেখা দিয়েছে নিঃসন্দেহে!
উপাচার্য-শিক্ষামন্ত্রী-সরকার যেখানে ইগো সঙ্কটে সেখানে একই পথে হেঁটেছে উপাচার্যদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ’। তারা শাবিপ্রবির এই শিক্ষার্থী আন্দোলনকে ‘দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলার একটি চক্রান্তের অংশ’ বলে অভিযোগ করেছে। উপাচার্যের পদত্যাগের আন্দোলনকে ‘নীতিবহির্ভূত’ বলেও দাবি করেছে সংগঠনটি।
শিক্ষার্থীদের হলের সিটভাড়া, ডাইনিংয়ের খাবারের নিম্নমান আর ইন্টারনেট সুবিধার মতো ন্যূনতম যে দাবি, সেটা থেকে পুলিশের নজিরবিহীন হামলা ও শিক্ষার্থীদের জীবন বাজি রেখে মৃত্যুর মুখে এগিয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি কি রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া উপাচার্যের ‘প্রশাসক’ হিসেবে ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে না? বিশ্ববিদ্যালয় কি মালিক-শ্রমিক শ্রেণি প্রতিনিধিত্বকারী কোনো ক্ষেত্র, যেখানে একপক্ষ অন্যপক্ষের ন্যায্য দাবির আন্দোলন রুখতে এমন নির্যাতনের আশ্রয় নেবে?
উপাচার্য, শিক্ষামন্ত্রী-সরকারের পক্ষ থেকে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। তাদের ধারণা হয়তো ‘কতদিন আর না খেয়ে থাকতে পারবে’? এই ধারণা যে ভুল, তা এখন পর্যন্ত প্রমাণিত। এত এত শিক্ষার্থীর একজনও খাবার গ্রহণ করেনি, এই পাঁচদিনেও। অনেকে হাসপাতালে গেছে, যাচ্ছে, আছে; তবু খাবার গ্রহণ করেনি। খাবার গ্রহণ না করলে মৃত্যুর মুখে পড়তে পারে চিকিৎসকেরা এমন জানালেও তারা খাবার গ্রহণ করেনি। একজন শিক্ষার্থীর অস্ত্রোপচার করা হয়েছে রোববার, তবু সে খাবার গ্রহণ করেনি। একজন শিক্ষার্থী অনশনরত অবস্থায় হাসপাতালে গিয়ে বলেছে ‘যদি সে মারা যায়, তবে তার ছোট ভাই যেন সংহতি অনশনে বসে’! ভাবা যায়, কতটা ইস্পাত-দৃঢ় সংকল্প তাদের! মৃত্যুর সংশয়ও তাদের দাবি থেকে সরাতে পারছে না। তবু কালক্ষেপণে উপাচার্য, শিক্ষামন্ত্রী-সরকার! কতটা অমানবিক হলে সম্ভব এটা?
পুলিশের নির্যাতন, উপাচার্য-শিক্ষামন্ত্রী-সরকারের কালক্ষেপণ ও অমানবিক অবস্থান সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা তাদের দাবিতে অনড়। কী হবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের, কী আছে শিক্ষার্থীদের ভাগ্যে; অনিশ্চিত গন্তব্য। লাশ কি চায় কেউ— অনাকাঙ্ক্ষিত, তবু আশঙ্কা প্রবল! লাশ না হলেও এই শিক্ষার্থীদের জীবন ও শারীরিক অবস্থা যে অনেকটাই ধ্বংসের পর্যায়ে নিপতিত, তা বলছেন অনেকেই।
এত এত শিক্ষার্থীর জীবনকে ধ্বংস করে দিয়ে হয়ত কূটকৌশল অবলম্বন করে অথবা জোর করে উপাচার্যকে টিকিয়ে দেবে সরকার। কিন্তু এর ক্ষত কি এত সহজে মুছে দেওয়া যাবে? যাবে না। বরং দেশের শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষাব্যবস্থায় দগদগে ক্ষত হয়ে জানান দেবে এই ঘটনা। স্বেচ্ছাচার, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার জাতীয় প্রতীক হবে শাবিপ্রবির ঘটনা। আমরা না চাইলেও এটাই হচ্ছে, এটাই হতে চলেছে!
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক