সেঞ্চুরি। একটামাত্র সেঞ্চুরি। তা-ও আবার টেস্ট ক্যারিয়ারের ছয় বছর পার করার পর! এ আর এমন কী! আগামীর ক্রিকেট প্রেস সেভাবেই হয়তো দেখবে তার ১১৪ রানের ইনিংসটাকে। কিন্তু কজন জানার আগ্রহ দেখাবে তার প্রেক্ষিত, পরিস্থিতি আর প্রভাব! শুধু রানের পর রান নয়, এই ইনিংসে আছে অনেক অবজ্ঞা, উপেক্ষা, অপমান, লাঞ্ছনার জবাব। এ দেশের মানুষের কুয়াশা জড়ানো স্মৃতির ওপর এক মুঠো রোদ্দুর ফেলা ইনিংস এটা।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের রূপকথার জমানায় এ দেশের ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ থেকে আমজনতা, প্রায় সবার মুখে একটাই প্রশ্ন : তিনি কেন দলে? তাকে কেন বারবার সুযোগ দেওয়া হয়! আরও স্থূল রুচির পরিচয় দিয়ে অনেকেই বলেছেন, লিখেছেন, তিনি কোন ‘কোয়াটয়’ দলে জায়গা পাচ্ছেন! কেন তাকে দলে লাগেজের মতো বয়ে বেড়ানো হচ্ছে!
কেন? তার উত্তরটা আমাদের জানা ছিল না। হয়তো জানতেন শুধু ক্রিকেট-ঈশ্বর। আর হয়তো তিনি নিজে। তাই ৯৯ থেকে ১০০-তে পৌঁছাতে বল পুশ করেই ছুটেলেন। যেন জীবন বাঁচাতেই দৌড়ালেন। ডাইভ দিয়ে সিঙ্গেলটা নিলেন। উঠে দাঁড়ালেন। কোথায় উচ্ছ্বাস! এ যেন ক্রিকেট কয়েদখানা থেকে মুক্তির মুহূর্ত। হেলমেট খুলে, আকাশের দিকে তাকালেন। কী বললেন? হয়তো অস্ফুট স্বরে বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর শুধু তুমি আর আমিই জানতাম, এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল।’ তাই অন্যদের আর কিছু জানাতে চাননি তিনি। গ্যালারিতে দর্শকদের উল্লাস। ডেসিংরুমে টিমমেট আর কোচিং স্টাফদের উচ্ছ্বাস। কিন্তু তিনি নির্বিকার, নির্লিপ্ত।
এবং সেটাই স্বাভাবিক। যেখানে ফেসবুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ট্রলের শিকার হতে হয়েছে। ধর্ম-জাত-পাত নিয়ে কুৎসিত আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে। সেখানে একটা টেস্ট সেঞ্চুরি করার পর উচ্ছ্বাস দেখিয়ে লাভ কী! ক্রিকেটীয় স্টেটমেন্ট তার ব্যাটই দিয়েছে। মুখে কী বলবেন তিনি? সীমানা পেরিয়ে দেখলে তিনি নিজে দেখতে পাবেন এক বিখ্যাত বাঙালি ক্রিকেটারের ইংরেজিতে লেখা আত্মজীবনীর নাম—‘আ সেঞ্চুরি ইজ নট গুড এনাফ।’ সেই বইয়ের পাতা ওল্টালে দেখবেন কত অসম্মান, অবজ্ঞা. অবহেলা, হৃদয়ের কত রক্তক্ষরণ, ঘাম-শ্রম মিলেমিশে যে সাফল্য, সবকিছুকে গঙ্গা-যমুনার জলে ধুয়ে দিতে চেয়েছিলেন তার দলের ভেতর-বাহির থেকে। কিন্তু তিনি সেই ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ সময়েও অবিচল থেকে ছিলেন। ক্যারিয়ারের মাস্তুলটা উঁচিয়ে রেখেছিলেন। জানান দিয়েছিলেন, সব প্রশ্ন, সব অবজ্ঞা, উপেক্ষার জবাব সময় দিয়ে দেবে। টেস্ট ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে শূন্য করেই অন্য রকম এক মর্যাদা নিয়ে দাঁড়ি টেনেছিলেন খেলোয়াড়ি জীবনে। ১৩, ১৪ নয়, শূন্য রান করে ‘ব্র্যাডম্যান সরণিতে’-ই থেকে গেলেন শেষ ইনিংসে। কিন্তু আপনি ওই সরণির প্রবেশপথও এখনো খুঁজে পাননি। তবে আপনাকে ধন্যবাদ ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির পর ও রকম নির্লিপ্ত আর উদাসীন থাকতে পারার জন্য।
আপনাকে এখন হয়তো অনেকে অনেক প্রেসক্রিপশন দেবেন। কিন্তু আপনি নিজেই নিজের ভালোটা জানেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে যাকে স্ট্যাটাস ডিলিট করতে হয়; পরিস্থিতি, প্রেক্ষিত সবই তার বোঝার ক্ষমতা আছে। ব্যক্তিগত প্রাপ্তি নয়, প্রভাবের কথা ভাবুন। আপনার সেঞ্চুরি হলো কি হলো না, তাতে কী আসে যায়! আপনার ৯৫ যদি দলের জয়ের পথ তৈরি করে কিংবা হার বাঁচাতে পারে, সেটাই বড় কথা। পেশাদাররা নিষ্ঠাবান হয়। ক্রমোন্নতির পথে হাঁটেন। নিজের ক্রিকেট-সমৃদ্ধি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে যদি থমকে যান, তাহলে একদিন সকালে উঠে দেখবেন ক্রিকেট-ঈশ্বর সবকিছু কেড়ে নিয়েছেন। তাই দাঁড়ানো যাবে না। দৌড়াতে থাকতে হবে। পড়ে গেলে উঠে দাঁড়াতে হবে। যেভাবে দৌড়ে সেঞ্চুরি করে আবার উঠে দাঁড়ালেন।
একজন পেশাদার ক্রিকেটারকে পরামর্শ একজন পেশাদার পরামর্শক দিতে পারেন ওয়ান অন ওয়ান। কিন্তু সেই গোত্রে এই লেখক পড়ে না। তারপরও লেখাটায় দাঁড়ি টানার আগে একটা কথা বলতে চাই—‘খেলাটা আগাগোড়া উপভোগ করুন। অনেক ঝড়ঝাপটা আসবে। ভেতর-বাইরে থেকে। অসম্মানিত হবেন। হয়তো বিরক্ত হবেন। কিন্তু তার প্রকাশ ঘটালে নিজের ক্ষতি। ক্রিকেটটাকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসার বিকল্প কোনো স্টেটমেন্ট আপনার কাছে নেই।’
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।