• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫

প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যুদ্ধ নারী ক্রিকেটারদের


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৩, ০৬:২৪ পিএম
প্রাত্যহিকতার সঙ্গে যুদ্ধ নারী ক্রিকেটারদের

দেশজ নারী ক্রিকেটের পাথুরে জমিনে সোনার ফসল ফলানোর ইঙ্গিত মিলেছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। রূঢ় প্রাত্যহিকতার সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে উঠে আসতে হয়েছে দেশের নারী ক্রিকেটারদের। আর তাদের সৌজন্যে ভারত মহাসাগর আর আন্টলান্টিক মহাসাগরের মিলনস্থানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের খানিকটা অচেনা স্রোত যেন আছড়ে পড়েছে। জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি যেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব। তবু বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা যেন বুদ্ধিমুক্তির শিখার মতো জ্বলেছেন নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে। অনূর্ধ্ব উনিশ নারী বিশ্বকাপে বাংলাদেশের নারীদের পারফরম্যান্সে সেই আভাসটা মিলেছে। যদিও গণমাধ্যম থেকে সামাজিক যোগাযোগ, সব জায়গায় আলোচনাটা সীমিত। উচ্ছ্বাসটা হাওয়া হয়ে গেল সেমিফাইনালে উঠতে না পারায়। সেখানে আমাদের ক্রিকেট সংস্কৃতির দীনতা ফুটে উঠেছে। এই দেশের মানুষ যতটা ক্রিকেট ভালোবাসেন, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসেন সাফল্য আর গ্ল্যামারকে।

খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। বাংলাদেশের হতদরিদ্র ঘরের মেয়েগুলোর কাছে ক্রিকেট ছিল সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা বস্তু। এখন সেই ক্রিকেটে তাদের অন্যভাবে চেনাচ্ছে। জানাচ্ছে। আর অন্য রকম উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে বাংলাদেশের নারীদের সামর্থ্যের। ক্রিকেটাই ওদের কাছে হয়ে উঠছে জীবন। এটা যদি ঠিকঠাক খেলতে পারেন, তাহলে আলোকিত এক জীবন পাবেন তারা। না হলে হারিয়ে যাবেন সমাজের সেই কুসংস্কারের অন্ধকারে। এই মেয়েগুলোর কথা শুনলে মনে হয় সর্বস্ব সমর্পণ করে ওরা যুদ্ধের মাঠে নেমেছেন। যুদ্ধে লড়ল, জিতল। হারাল! তার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করলেন তারা লড়াইটা করতে শিখেছেন।
কিন্তু এখনো আমাদের সমাজ অকৃপণ হতে পারেনি নারীর প্রতি। এই যে আইসিসির যেকোনো টুর্নামেন্টে যেকোনো ফরম্যাটে বাংলাদেশের প্রথম দল হিসেবে অস্ট্রেলিয়াকে হারালেন অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ক্রিকেটাররা। তারপর উড়িয়ে দিল শ্রীলঙ্কাকে। এই সাফল্যে খ্যাতি-যশ-সম্মান-পয়সা অনেক কিছুই পাওয়ার কথা তাদের। কিন্তু পাচ্ছেন কি। পুরুষরা দ্বিপক্ষীয় কিংবা ত্রিদেশীয় সিরিজে অস্ট্রেলিয়াকে হারালে আবেগের যে ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে, এই সমাজে তার সামান্য কি টের পাওয়া গেছে নারীদের এই সাফল্যে। অস্ট্রেলিয়াকে যে হারিয়েছিল নারীরা, সেটা হয়তো মাসখানেকের ব্যবধানে আমজনতার স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। শুধু অস্ট্রেলিয়া কেন, যে ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে, প্র্যাকটিস ম্যাচে তাদেরও হারিয়েছিল বাংলাদেশ।

আইসিসির টুর্নামন্টে অস্ট্রেলিয়ার কোনো দলকে প্রথম হারানো। এটা ইতিহাস। নতুন ইতিহাস তৈরিটা সবার মনে থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ নারী ক্রিকেটারার যে ইতিহাস তৈরি করলেন, পরবর্তী সময়ে সেটা হয়তো ছাপিয়ে যাবেন অন্যরা। কিন্তু প্রথমটার ছাপ থেকে যাবে। তাদের এই পারফরম্যান্স বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিশাল ইমপ্যাক্ট ফেলার কথা। প্রায় সম্পূর্ণ অপরিচিত একঝাঁক তরুণী কী ঝাঁকুনি দিল বিশ্ব ক্রিকেটকে। সাফল্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে হয়তো ওরা ওঠেনি। কিন্তু ওঠার জন্য পা তো ফেলেছে। সাফল্যের অনুভূতির একটা অভিজ্ঞতা তারা পেয়েছে। এই অভিজ্ঞতাই ভবিষ্যতে তাদের সাফল্যের ব্যাকরণ তৈরি করতে সাহায্য করবে।

১০ ফেব্রুয়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনে শুরু হচ্ছে সিনিয়র নারীদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। সেই টিমেও আছেন অনূর্ধ্ব উনিশ দলের বেশ কয়েকজন ক্রিকেটার। এরই মধ্যে কাপ অভিযানে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছে গেছে নারী দল। তাদের ঘিরে আশা আর স্বপ্নের একটা বলয় তৈরি হয়েছে। কিন্তু নারী ক্রিকেট এখনো বাংলাদেশের মানুষের কাছে খানিকটা উপেক্ষিত রয়ে গেছে। ক্রিকেট বোর্ড বলুন, মিডিয়া বলুন, সবার কাছেই নারী ক্রিকেট ‘দুধ-ভাত’ রয়ে গেছে। খেলার দুনিয়ায় নারীদের ক্রিকেট একটু উপেক্ষার চোখে দেখার প্রবণতা রয়ে গেছে। সেটা প্রচারমাধ্যম থেকে জনমানস, সব জায়গায়। এর পেছনের কারণ কোথাও দারিদ্র্য। কোথাও বঞ্চনা। কোথাও লিঙ্গবৈষম্য চিন্তাচেতনা। অথচ বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সাফল্য ‘এশিয়া কাপ’ নারীরাই জিতেছেন। কিন্তু সাফল্যের সেই কথা মাথায় রেখে বদলায়নি প্রেক্ষাপট। সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে বিজ্ঞানসম্মত পরিকাঠামো, উন্নত প্রশিক্ষণ আর ফিটনেস বাড়ানোর জন্য তেমন বলার মতো পদক্ষেপই-বা নেওয়া হলো কোথায়? হয়তো বলা হবে; আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে।
নারী ক্রিকেটের সাফল্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ক্রিকেটের মানচিত্রটাও পাল্টানো দরকার। নারী আর পুরুষ ক্রিকেটের বৈষম্য দূর করতে ভবিষ্যতে নারীদের বিপিএল আয়োজন, নারী ক্রিকেটের টেলিভিশন সম্প্রচার করার মতো কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নেওয়া উচিত। তাহলে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার নারীদের সঙ্গে বাইশ গজে এ দেশের নারীও চোখে চোখ রেখে লড়াই করতে পারবেন।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!