• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

পায়ে জীবন নামক ফুটবল নিয়ে ওরাও জিততে চায়


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩, ২০২২, ০৩:৩৬ পিএম
পায়ে জীবন নামক ফুটবল নিয়ে ওরাও জিততে চায়

বিশ্বকাপ আসে। বাংলাদেশের মানুষের দু’চোখে স্বপ্ন ভিড় করে। সেই স্বপ্নের নাম চ্যাম্পিয়ন। তবে নিজের দেশ নিয়ে সেই স্বপ্নের পেছনে ছোঁটে না তারা। কারণ বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় এদেশে মানুষের রক্তের গ্রুপ টেস্ট করা হলে হয়, ‘এ’ পজিটিভ,  না হয় ‘বি’ পজিটিভ রিপোর্ট আসবে! অন্তত এই এক মাস ফুটবল ল্যাবে টেস্ট করা বাঙালির রক্তে অন্য কোনো গ্রুপের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না!

‘এ’-তে আর্জেন্টিনা। আর ‘বি’-তে ব্রাজিল। এই হচ্ছে এদেশের ফুটবল! বাঙালি কবে বি-তে বাংলাদেশ ভাবতে পারবে তা স্বয়ং ফুটবল-ঈশ্বরও জানেন না! তবে ফুটবল-ঈশ্বর জানেন, বিশ্বকাপ ফুটবলের নিয়ে এদেশের মানুষের  আবেগ কত প্রবল, কত তীব্র, কত উগ্র! জানে বিশ্বফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফাও। বিশ্বকাপে একটা ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনা ম্যাচ তাদের সমর্থকদের পেছনে ছুঁটে আসে আনন্দ, বেদনা, আঘাত, দুঃখ, শোক, জ্বালা, যন্ত্রণা! এই সব শব্দ তাদের মনে এসে আছড়ে পড়ে ‘গোল’ নামক আওয়াজের পর। কাতারে কাল (শুক্রবার) ক্যামেরুনের একজন আবুবকরের মাথা ছুঁয়ে  বল ব্রাজিলের জালে জড়াতেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়ে শেষরাতের বাংলাদেশ!

গোল করে আবুবকর  জার্সি খুলে দৌঁড়ে গেলেন মাঠের বাইরে। জানতেন আর ফিরতে পারবেন  না। কারণ ফুটবল আইনের ব্যত্যয়  ঘটিয়েছেন। কিন্তু জানতেন তার ‘গোল’ ফুটবল বিশ্বে অন্যরকম এক ইতিহাসের জন্ম দিতে পারে। এবং শেষ পর্যন্ত দিল। আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে ব্রাজিলকে হারালো ক্যামেরুন। এ তো সেই ক্যামেরুন, যারা ’৯০-এর বিশ্বকাপে সেই সময়ের চ্যাম্পিয়ন ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমকে দিয়েছিল বিশ্বকে। রজার মিল্লার সেই নাচ। যন্ত্রণাকাতর মুখে ম্যারাডোনার উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকা খণ্ড খণ্ড ছবির মতো ভিড় করছিল চোখের সামনে! নেইমার, রিচার্লিসন, ভিনিসিয়াস জুনিয়র— কাউকে খুঁজে পায়নি চোখ! দেখবো কীভাবে? ওদের কাউকে মাঠে নামানি ব্রাজিল কোচ তিতে! কারণ তার দল আগেই শেষ ষোল-তে। তাই রিজার্ভ বেন্ঝের শক্তিটা একটু পরখ করে দেখতে চাইলেন ব্রাজিলের ইতিহাসে দীর্ঘ সময় কোচের দায়িত্বে থাকা তিতে। কী দেখলেন? ফ্রান্সের কোচ দিঁদিয়ের দেঁশম যা দেখেছিলেন, তিনিও তাই দেখলেন। গোল হজম এবং হার! আর ঐ ম্যাচের পর আমি দেখছিলাম পেলের একটা সাক্ষাৎকার। যেখানে তিনি জানিয়েছেন, তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষার কথা। ‘তুমি সাফল্যের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে দাঁড়িয়েও কাউকে ছোট করে দেখবে না!’ তিতে কী ক্যামেরুনকে একটু ছোট করেই দেখেছিলেন!
এর কোনো উত্তর হয়তো পাওয়া যাবে না। আপনার আমার চেয়ে কোচ তিতে অনেক অ-নে-ক ভালো ফুটবল বোঝেন। তিতে কেন, আমাদের চেয়ে ভালো ফুটবল তো ‘পল দ্য অক্টোপাসও’ বোঝে। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন কে হবে তাও সে বলে দিয়েছিল। তবে বাঙালিও এখন অনেক বেশি বুঝদার এবং সামাজিক হয়েছে। অন্য দেশের জয়ে খুশি হোক, পরাজয়ে দুঃখ পাক, সে উচ্ছ্বাসে তেমন চিৎকার করে না! পরাজয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে না! তার সব আবেগ অনুভূতি জমা করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্টে!

এবারের বিশ্বকাপ যেমন ‘ভার’-এ ভারাক্রান্ত, তেমনি দর্শকের অনুভূতি আক্রান্ত ফেসবুক-টুইটার-ইনস্টাগ্রামে। প্রিয় দলের জয়ের আনন্দ, হারের বেদনা ভাগ করে নেওয়ার লোকও কমে আসছে কী তার চারপাশে! হয়তো হ্যাঁ। আবার না! কারণ, এখনো ব্রাজিল আছে। আর্জেন্টিনা আছে। সমস্ত বর্ডার লাইন ক্রস করে, সব সীমানার চক্ষু ছাড়িয়ে গোটা বিশ্ব এসে মিলে যায় এক জায়গায়। শুধু মিলতে পারে না বাঙালি ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা নিয়ে! তিতের দল হেরেছে তাতে কি মিষ্টি সুখ আর্জেন্টাইন সমর্থকদের! কিন্তু তাতে কি কাপ জয়ের স্বপ্ন শেষ হয়েছে নেইমারদের।

আসলে বাঙালির এমনই। রাতে ড্রয়িংরুমে বা রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিশ্বকাপ দেখছে। ঢাকার কারওরান বাজার কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মাঠে লাগানো বড় পর্দায় চোখ রাখা মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকান। কত অনুভূতি, কত অভিব্যক্তি খেলা করে যায় সেখানে। কত মানুষের বালিরেখাময় মুখে ফুটে বের হয়, অভাব, দুঃখ, দুশ্চিন্তা, অনাহারের রেখা! যে তরুণের মুখটা অসম্ভব উত্তেজনায়, উৎসাহে জ্বলজ্বল হয়ে ওঠে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার জয়ে, সে নিজে জানে না জীবনের আগামী দিনগুলোতে সে জয়ী হতে পারবে কী না! কিন্তু বিশ্বকাপ ফুটবল এলে সেই লোকটা, যে কী না ক্রমাগত ঘা খেয়ে খেয়ে  ক্লান্ত, অবসন্ন— সেও হয়ে ওঠে সাহসী যোদ্ধা! পায়ে জীবন নামক ফুটবল নিয়ে সেও ছুটতে থাকে। অন্তত নব্বই মিনিটের ঐ ফুটবল যুদ্ধ দেখতে দেখতে। জীবনকে নিজের পায়ে যেমন খুশি নাচাতে চান। যদিও তাকে ট্যাকেল করার জন্য পেছন থেকে ছুটে আসে রোজকার অভাব, অনাটন, দুঃখরা।

ক্যামেরুনের কাছে ব্রাজিল হেরেছে।  কিন্তু তাদের সমর্থকদের স্বপ্ন হারেনি।বিশ্বকাপ শেষ হবে। অনেকের স্বপ্ন হারিয়ে যাবে। আবার সেই স্বপ্নগুলো চার বছর পর হাজির হবে সওদাগরের মতো বিশ্বকাপের বাজারে!

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!