• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

প্রাণপ্রিয় নেতার জন্মভূমে ফিরে আসার মহিমা


ড. মো. আইনুল ইসলাম
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১০, ২০২৩, ০৬:৩২ পিএম
প্রাণপ্রিয় নেতার জন্মভূমে ফিরে আসার মহিমা

আজ ১০ জানুয়ারি, বাঙালি জাতির এক ঐতিহাসিক দিন। ১৯৭২ সালের আজকের এই দিনে স্বাধীন দেশের মাটিতে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, রূপকার ও স্বাধীন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ ফিরে আসার ঠিক দুদিন আগে অর্থাৎ ৮ জানুয়ারি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথা বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস-এর দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় লিড নিউজের শিরোনাম ছিল, “শেখ মুজিব ইজ ফ্রি/ অ্যারাইভড ইন ব্রিটেন/ ইয়াহিয়া ইজ অ্যারেস্টেড”। ইংরেজিতে লেখা ওই নিবন্ধের বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, “পাকিস্তানের কারাগারে নয় মাস বন্দী শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত হয়ে আজ লন্ডনে উড়ে এসেছেন। তিনি একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘একটি স্বাধীন বাঙালি জাতি এখন একটি অচ্যালেঞ্জযোগ্য বাস্তবতা’ এবং ‘সমস্ত দেশের কাছে নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার এবং সহায়তা দেওয়ার জন্য আবেদন করছি, যাতে আমার লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা না যায়...’।” নিউইয়র্ক টাইমস-এর নিবন্ধটির শেষ লাইনটি হুবহুই তুলে ধরছি, তার ঐতিহাসিক তাৎপর্য তুলে ধরতেই: “প্রাইম মিনিস্টার হিথ, হু ওয়াজ আউট ইন দ্য কাউন্ট্রি, কুইকলি রিটার্নড টু টেন ডাউনিং স্ট্রিট টু মিট শেখ মুজিব”। ২০০ বছর বাংলা ভূখণ্ডে শাসন-শোষণ-অত্যাচার চালানো ইংরেজদের প্রধানমন্ত্রী হিথ পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের কবল থেকে বাংলা ভূখণ্ডকে বীরদর্পে মুক্ত ও স্বাধীন করা ‘শেখ মুজিব’ নামক মানুষটির সাথে বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সাক্ষাৎ করার কৃতিত্ব অর্জনের লোভ সংবরণ করতে পারেননি—এমনই ছিল মুক্ত মুজিবের মহিমা। এ যেন পাশ্চাত্যে ‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’। লন্ডনে অবতরণের পর পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সংবাদ ও ছবি ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহজুড়ে বিশ্বসংবাদপত্রের ধাবাবাহিকভাবে শিরোনাম হয়েছে।

বিশ্বের আনাচকানাচে নিপীড়িত ও শোষিত কোটি কোটি মানুষের মুক্তির দূত হয়ে ওঠা শেখ মুজিবুর রহমান যেদিন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন, সেদিন সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ বেতার থেকে অনবরত ধারাবিবরণী দেওয়া হচ্ছিল। বিমানবন্দরে অপেক্ষমান লাখো জনতার চোখ-মুখে বয়ে যাচ্ছিল অন্যরকম এক দ্যুতি। মহান নেতার মুক্তির আনন্দে অনেকের চোখ তখন অশ্রুসজল। ঘরে ফিরে এসেছেন তাদের প্রিয় পিতা-প্রিয় নেতা, যিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন, বাঙালি জাতিকে স্বাধীন মানুষের পরিচয় এনে দিয়েছেন। বিমানে বসে তাঁর বিধ্বস্ত মাতৃভূমি অবলোকন করে এবং হাজারো মানুষের ভবিষ্যৎ চিন্তাই হয়তো মহাশক্তিশালী এই নেতাকে হয়তো ভেতরে ভেতরে বিষাদগ্রস্ত করেছিল। তাই তো সেই দীর্ঘ ঋজু দেহ, প্রিন্স কোট আর উজ্জ্বল মুখচ্ছবির মাঝেও শেখ মুজিবের চেহারায় সেদিন একটু বেদনার ছাপও মিশে ছিল। তবে কবর খুঁড়ে প্রস্তুত করে রাখা পাকিস্তানের কারাগারে দীর্ঘদিন থাকা, আর পথের ক্লান্তি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু নিশ্চিয়ই দেশের মাটিতে পা দিয়ে অতুলনীয় এক গর্বে গর্বিত হয়েছিলেন। কারণ, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসা ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল তাঁর প্রাণপ্রিয় স্বদেশ, প্রিয় মাটি, প্রিয় মানুষ।

বিমানবন্দরে সেদিন চাক্ষুশ করতে পারার সৌভাগ্য আমার সেদিন হয়নি। কারণ, সে সময় থাকতাম রাজধানী ঢাকা থেকে শত শত মাইল দূরের অজপাড়া এক গ্রামে। তবু চোখ বুঝে ঠিকই এখন বুঝতে পারি, বিমান থেকে নামার আগে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ‘তিনি’ বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেন, ‘তাঁর’  চোখের দৃষ্টিতে ছুঁয়ে ছিল প্রিয় আলো প্রাপ্তির অসামানান্য এক অনুভূতি। তাই তো বিলেতে বসে ইংরেজ সাংবাদিকেরা সেদিনের সেই অপরাহ্ন নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদনে লেখেন, “ঢাকায় আজ জনতা তাঁকে এক বিজয়ী বীরের সংবর্ধনা দেয়। তিনি বিমানবন্দর থেকে সোজা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় পৌঁছান।” দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যে জাতির মননে স্বাধীনতার বীজমন্ত্র  বুনে ছিলেন, সেই দেশের রক্তভেজা মাটিতে ফিরে এসেই বঙ্গবন্ধু উপস্থিত হয়েছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানে, যেখানে দাঁড়িয়ে সাতই মার্চে এক কালজয়ী ভাষণে বাঙালি জাতির জন্য মুক্তি ও স্বাধীনতার চূড়ান্ত ডাক দিয়েছিলেন। অত্যন্ত ক্লান্ত শেখ মুজিব তাঁর ৪০ মিনিটের বক্তৃতায় মাঝেমধ্যেই থেমে যাচ্ছিলেন। আবেগ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, “পৃথিবীর কোনো জাতিকেই স্বাধীনতা অর্জন করার জন্য এত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি।”  সেদিন তিনি বাংলাদেশের চিরকালীন রূপরেখা উপস্থাপন করে বলেছিলেন, “বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা।” তিনি তাঁর ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করার অপরাধে হত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক আদালত ও তদন্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি করেন। সত্যিকারের স্বাধীনতার আস্বাদ পাওয়া লাখো মানুষের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসের মাঝেও বঙ্গবন্ধু মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে বারবারই শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁর দুই চোখ গড়িয়ে মাঝেমধ্যেই অশ্রু ঝরে পড়ছিল। সেদিন তিনি আবেগভরা কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এবং চিরদিন স্বাধীন থাকবে।’

স্বাধীনতার অর্ধশশতক পরে এ কথা নিশ্চয়ই বলা যায়, যদি পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা তাঁকে হত্যা করত, তাহলে আমরা আজকের এই বাংলাদেশ পেতাম না। বঙ্গবন্ধুর সমালোচকদের কেউ কেউ এখনো বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের গ্রেপ্তারের সুযোগ না দিয়ে আত্মপোপন করতে পারতেন। আত্মগোপনে থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিতে পারতেন। যারা এ ধরনের অবিবেচকের কথা বলেন, তারা আসলে সেই সময়ের বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও দূরদর্শিতা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখেন না। কারণ, বঙ্গবন্ধু রাজনীতি করেছেন সিংহের বেশে, বীরের মতো। আজন্ম তিনি লুকোছাপাকে ঘৃণা করেছেন, যার প্রমাণ আমরা পাই তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি না। কারণ আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না।’ (পৃ. ১৩৪)।

আত্মগোপন না করে গ্রেপ্তার হওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল বঙ্গবন্ধুর জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্তের একটি। তিনি সাংবিধানিক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে ছিলেন বলেই বর্বর আক্রমণের শিকার বাংলাদেশ তখন আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন পেয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে বিশ্বজনমত আমাদের পাশে ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়া সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বিখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, “সেদিন সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তারা কমান্ডো বাহিনী দিয়ে ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন দেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বের হওয়া নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক। ... আমি ইচ্ছা করলে যেকোনো জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে ছেড়ে আমি কেমন করে যাব? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করব, মৃত্যুকে বরণ করব। পালিয়ে যাব কেন? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল, তোমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলো। ... আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। ...আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।” রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর এই আত্মমর্যাদাবোধ এবং দেশবাসীর সম্মানকে তিনি যে দৃষ্টিতে দেখেছেন, তার তুলনা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

মনে রাখা দরকার, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও মানুষের মনে ছিল শঙ্কা ও বিষাদের ছাপ। এ ছাড়াও যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরির মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শারীরিক উপস্থিতি ছিল অনিবার্য—অনস্বীকার্য। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতি যে কতটা প্রয়োজন ছিল, তা বর্তমান সময়ে অনুধাবন করা দুঃসাধ্য। তখন আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগসহ সবারই ভাব ছিল, আমিই রাজা, আমিই স্বাধীনতা এনে দিয়েছে, দেশ স্বাধীন করেছি। কেউই কাউকে মানছিল না। তরুণ নেতারা অস্থায়ী সরকারের কোনো কথা শুনছিল না। এককথায় যাকে বলা যায়, চরম নৈরাজ্যকর এক অবস্থা। বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে মুক্তিযোদ্ধারা যে অস্ত্র জমা দিতেন না, তা নিয়ে এখন নিশ্চয়ই কারো কোনো সন্দেহ নেই। ভারতীয় সৈন্যরাও নিশ্চয়ই ভারতে ফিরে যেত না। অনেক দেশের স্বীকৃতিও আমার পেতাম। তাঁর প্রত্যাবর্তনের দিন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব পূর্ণতা পায়। সত্যি কথা বলতে কি, ১০ জানুয়ারি প্রকৃত অর্থে বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিপূর্ণতার দিন। দেশবাসী তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে নতুন স্বপ্নে, নতুন আশায় নতুন এক পথে চলার প্রেরণা পেয়েছিল। প্রাণভরে মুক্তির পূর্ণ স্বাদ উপভোগের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কোনো বিকল্প ছিল না। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নতুন এক অলোকযাত্রায় প্রবেশ করেছিল।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর প্রায় ৫০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। দুর্বৃত্তরা বারবার স্বাধীন বাংলাদেশকে আঘাত না করলে, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে আজ নিশ্চয়ই আমরা মহান এক জাতির মর্যাদা পাকাপোক্তভাবেই পেয়ে যেতাম। বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তি ধ্বংস করে শত্রুরা কী পেয়েছে! বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তো ঠিকই বাঙালি জাতির পিতার সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের যাত্রা বহালই রেখেছেন। হৃদয়ের গভীর থেকেই প্রত্যাশা করি, বাঙালির অনাগত প্রজন্ম যেন বঙ্গবন্ধুর চিরপ্রার্থিত সোনার বাংলাদেশেই বাস করে।

 

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি।

Link copied!