• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

সুলতানার দুঃস্বপ্ন—নারীই যখন নারীবান্ধব নয়


তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৩, ০৯:০৭ এএম
সুলতানার দুঃস্বপ্ন—নারীই যখন নারীবান্ধব নয়

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে কিছু ট্রল ঘুরে বেড়ায়, যেখানে দেখানো হয়, বান্ধবীরা ওপরে ওপরে জান-প্রাণ খাতির দেখালেও, ভেতরে ভেতরে একে অপরের প্রতি কতটা ঈর্ষান্বিত! নারীরা পরস্পরের প্রতি এতটাই হিংসুটে হয়ে থাকে যে, তারা ঠিকমতো বন্ধুও হতে পারে না— ট্রলগুলোর উপজীব্য এটাই। শুধু বান্ধবীদের বেলায়ই নয়, ঘরেও বউ-শাশুড়ি, ননদ -ভাবীর দ্বন্দ্ব যেন একটি স্বাভাবিক চিত্র। আমাদের সমাজে এটিকে এত বেশি সাধারণ ঘটনা হিসেবে দেখা হয় যে, কোনো পরিবারে এমন দ্বন্দ্ব না থাকাটাকেই অস্বাভাবিক মনে করা হয়ে থাকে। অথচ বেগম রোকেয়া সুলতানাস ড্রিমে দেখিয়েছেন, ঈর্ষান্বিত নারীরা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে নতুন নতুন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র আবিষ্কার করছেন। ১২২ বছর আগে বেগম রোকেয়া যেভাবে চিন্তা করতে পেরেছিলেন, আজ এই চ্যাটজিপিটি-এআই-এর আধুনিক যুগেও আমরা সেভাবে চিন্তা করতে পারি না। আর সেজন্যই ‘এসএসসি ফেল যুবককে নিয়ে ৪ তরুণীর মারামারি!’ চমকপ্রদ এই শিরোনামের খবরটি প্রকাশিত হয় ভ্যালেন্টাইনস ডের অল্প কদিন আগে। তরুণীদের মারামারি ও চুল ধরে টানাটানির ভিডিওটিও মুহূর্তে ভাইরাল! এর আগে ইডেন কলেজের সামনেও চার তরুণীর চুল ধরে মারামারি করার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। ভিডিওটিতে একটি জনপ্রিয় নারকেল তেলের বিজ্ঞাপন জুড়ে দিয়ে ট্রলও করা হয়। শুধু এই দুটি ঘটনাই নয়, ইডেন কলেজে রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে নারী শিক্ষার্থীরা চেয়ার ছোঁড়াছুড়ি করে মারামারি করে, যা সব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে প্রচারিত হয়েছে।

নারীদের মারামারি চুলোচুলির ঘটনা সব সময়ই সংবাদ মাধ্যমের মুখরোচক খবর। সাধারণ মানুষের কাছে হাসির খোরাক। সেই সঙ্গে কথার খৈ ফোটে, ‘নারীই নারীর শত্রু’ এমন পুরুষতান্ত্রিক প্রবচনের। অথচ নারীর ওপর নারীদের অত্যাচার করতে লেলিয়ে দিচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। নারীদের রেষারেষিতে বিনোদন পায়, নিরাপদ থাকে খোদ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। তাই পাবলিক বাসে নারীদের জন্য বরাদ্দ ৪/৫টি আসন নিয়ে নারীদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় কোন্দল। কেউ কাউকে এতটুকু জায়গা ছেড়ে দেবে না। ফলাফল হিসেবে শুনতে হয়, পুরুষতন্ত্রের টিটকারি। অথচ, জনসংখ্যা অনুযায়ী পাবলিক বাসে নারীদের জন্য আরও বেশি সংখ্যক আসন সংরক্ষিত রাখলেই এ সমস্যা এড়ানো সম্ভব।

বর্তমানে সমাজে পরকীয়া ও অনৈতিক সম্পর্ক এমনভাবে বেড়ে চলেছে, এর প্রভাব আমরা পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই। খুন, আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ অপরাধ এসব কারণে দিন দিন বাড়ছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই, মিডিয়ার তারকা নারীদেরও দেখা যায়, বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে তৈরি করছে। এই নারীরা যদি সত্যিই নারীবান্ধব হতেন, তাহলে সেই সব পুরুষদের স্ত্রীদের যন্ত্রণার কথা চিন্তা করে হলেও এসব সম্পর্কে থেকে বেরিয়ে আসতেন। ইদানীং আবার আত্মজীবনীতেও এসব সম্পর্কের কথা ফলাও করে প্রকাশ করে কেউ কেউ বাহবাও কুড়াচ্ছেন! নারীবাদী হিসেবে যারা পরিচিত তারাও দেখা যায়, পরস্পরের সঙ্গে সামান্য মতের অমিল হলেই একে অপরের নামে নোংরা ভাষায় কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছেন। নারীবাদ নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে যেখানে আরও সচেতনতা তৈরি করার কথা, সেখানে তারা একে অপরকে ব্যক্তিগতভাবে নোংরাভাবে আক্রমণ করে ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন। বলাই বাহুল্য, তারা কতটা নারীবান্ধব! মতের অমিল হলেও যে পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও মত প্রকাশ করা যায়, হয়ত সে কথা তারা তখন ভুলে যান! এসব কারণে, নারীবাদ নিয়ে অনেকের মনেই নেতিবাচক ধারণা কাজ করে।

নারীর প্রতি নারীর আচরণ কেমন, তার আরও কিছু বাস্তব উদাহরণ দেখা যাক। কোনো নারী যখন যৌন হেনস্থা বা ধর্ষণের শিকার হন, তখন ‘পাশের বাসার আন্টি’ জাতীয় কিছু নারীই ভিকটিম নারীর পোশাক ও চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটাতে থাকেন। কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি, নরসিংদীতে এক তরুণী শুধুমাত্র স্লিভলেস জামা পরেছে বলে আরেক নারী তাকে জঘন্যভাবে শারীরিক আক্রমণ করেছে। যা একটি ফৌজদারি অপরাধ। এরকম আক্রমণকে যৌন হেনস্তাও বলা চলে। তারপরেও তরুণীর ওপর এমন আক্রমণকে বহু নারীই সমর্থন করেছেন, শুধুমাত্র পোশাকের কারণে। এতেই বোঝা যায়, নারীর প্রতি নারীর দৃষ্টিভঙ্গি কতটা কলুষিত ও নোংরা। নারীরাই তাহলে নারীবান্ধব নয়! তাই নারীর পথচলা হয়েছে আরও কঠিন। হুমায়ুন আজাদ তো বলেই গেছেন, ‘পুরুষতন্ত্রের চেয়ে পুরুষ তন্ত্রে দীক্ষিত নারী, নারীর জন্য আরও বেশি ভয়ঙ্কর।’

নারীর প্রতি পুরুষের সহিংসতার খবর এতদিনে যেন পুরোনো হয়ে গেছে। এখন নারীরাও নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রনেত্রীদের ভয়ঙ্কর পাশবিকতার শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ নারী শিক্ষার্থীদের। এর আগে ঢাবি, ইডেন, জাবি, রাবিতে নারী শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের খবর পাওয়া গেলেও, সম্প্রতি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের চূড়ান্ত জঘন্য রূপ প্রকাশ পেয়েছে। ফুলপরী নামের এক সাধারণ শিক্ষার্থী সব ট্যাবু ভেঙে প্রকাশ করেছেন ছাত্রনেত্রীদের সহিংসতার কথা। শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পরেও সেখানে নারী শিক্ষার্থীদের করা হতো যৌন নির্যাতন। আর সেসব করতো হলের নেত্রী পর্যায়ের শিক্ষার্থীরাই। অর্থাৎ নারীর প্রতি নারীর সহিংসতার মাত্রা এবং ধরনও দিন দিন ভয়ঙ্কর হচ্ছে। এতদিন গ্রামের বউ শাশুড়ি বা ননদ ভাবীরা ঝগড়া করতেন। পরস্পরের কুৎসা রটাতেন। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত আধুনিক নারীরাও এর থেকে খারাপ মানসিকতার পরিচয় দিলেন। যা খুবই দুঃখজনক।

আসলে আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে নারীদের শারীরিক বা মানসিকভাবে আঘাত করাকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয় না। এখন তো যৌন হেনস্তা করাকেও কেউ আমলে নিচ্ছে না। তাই নারীও তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল আরেক নারীকে যৌন নির্যাতন করতে পারছে অতি সহজে। দেশের দুই প্রধান নেত্রী যেখানে পরস্পরের প্রতি কাদা ছোঁড়াছুড়ি করেন, পরস্পরের চরিত্র নিয়ে কুৎসা রটিয়ে যান, কেউ গোলাপি শাড়ি পরলে আবার কেউ হজ করে হিজাব পরে আসলে বাজে সমালোচনার শিকার হন, নারী হয়েও আরেক নারীর প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করেন না, সেখানে ‘সুলতানাস ড্রিম’ আমাদের কাছে ‘সুলতানাস নাইটমেয়ার’ হয়েই রইবে হয়তো।

লেখক : শিক্ষক ও লেখক।

Link copied!