• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : কীভাবে মোকাবিলা করবে নারী


আফরিদা ইফরাত
প্রকাশিত: নভেম্বর ৩০, ২০২২, ০২:৫২ পিএম
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি : কীভাবে মোকাবিলা করবে নারী

যুদ্ধের প্রভাব কতটা সর্বনাশা হতে পারে, তা সম্প্রতি সবাই বুঝতে পারছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তেল-জ্বালানি সংকট, দ্রব্য-মূল্যবৃদ্ধি, বৈশ্বিক সরবরাহে ঘাটতিসহ আরও অনেক সমস্যা সৃষ্টি করেছে। সারাবিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি একটি বড় সমস্যা। যুক্তরাষ্ট্রে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বাধিক বেতন নির্ধারিত হলেও আয়-ব্যয় সঙ্গতি রক্ষা করা যাচ্ছে না। সেইসঙ্গে ইউরোপে রক্ষণশীলদের উত্থান নতুন করে আলোচনার বিষয়ে হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবকিছু বিবেচনায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা সবার মনে। বিশ্বের অন্য দেশের মতো আমাদের দেশেও এমন আশঙ্কা ছুঁয়ে গেছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সংসারের খরচ কাটছাঁট করতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে অবস্থা আরও নাজুক হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে টিসিবির ট্রাকের সামনে মানুষের সারির খবর সাধারণ চিত্র হয়ে পড়েছে। এই দুর্ভিক্ষের সময় কম খেয়ে সংসার সামলানোর দায় অবধারিতভাবে পড়ছে নারীর ওপর।

জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়ছে নারীর জীবনে। প্রতিটি পণ্যে ১০-১৫ টাকা বাঁচানোর জন্য সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত টিসিবির দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ানো মানুষের মধ্যে নারীরাই বেশি থাকেন। যে নারীরা কর্মজীবী, তারা স্বল্পমূল্যে জিনিসপত্র কিনতে লাইনে দাঁড়িয়ে সময়মতো কাজে পৌঁছাতে পারেন না। কম খেয়ে সংসারের সবকিছু সামলানোর দায়িত্ব পড়ে নারীর ওপর। একইভাবে শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়ায় অনেক পরিবার খরচ কমাতে মেয়েশিশুর পড়া বন্ধ করে দিচ্ছে। এতে বাল্যবিবাহ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ইতোমধ্যে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। কেন কমেছে, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনা রয়েছে। কিন্তু খরচ সংকুলানের দায় যে নারীর ওপর তা অনুমান করতে কোনো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। প্রশ্ন আসতে পারে, এখনও তো দুর্ভিক্ষ আসেনি। তাহলে এ নিয়ে অত চিন্তিত হওয়ার কী আছে?

হ্যাঁ, এ কথা সত্য, এখনও দুর্ভিক্ষ আসেনি। রাষ্ট্র উৎপাদনমুখী হওয়ার উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি নানা কর্মপরিকল্পনা নিতে শুরু করেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দুর্ভিক্ষ একটি অনুমান-সম্ভাবনা মাত্র। কিন্তু কথাটির তাৎপর্য হয়তো আমরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি। রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে যা তার হিসেব একটি। আর রাষ্ট্রের জনগণের কল্যাণের হিসেব আরেক। অর্থনীতিতেও এ জন্য ব্যষ্টিক অর্থনীতি ও সামগ্রিক অর্থনীতি বলে দুটো ভাগ আছে। সামগ্রিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ক্ষুদ্র আয়তনের তুলনা করা ঠিক নয়। ঠিক নয় কারণ জাতীয়ভাবে প্রস্তুতির হিসেব এবং রাষ্ট্রের মানুষের কল্যাণের হিসেব আরেক।

প্রতিটি রাষ্ট্রকেই অর্থনৈতিকভাবে কিছু কঠিন মুহূর্ত পার করতে হয়। সেই কঠিন মুহূর্ত পার করার সময়ে অবধারিতভাবে নাগরিকদের একটি অংশ ভুক্তভোগী হন। এ কথা সত্য, তাদের জন্য কিছু করার আপাতত কোনো সুযোগ নীতিনির্ধারকদের থাকে না। কিন্তু তাদের সচেতনতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বড় সুযোগ ঠিকই থাকে। বিষয়টি স্পষ্ট করা জরুরি। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে, ‘দেশের বর্তমান সামগ্রিক অবস্থা, নারীরা কী ভাবছেন’ শিরোনামে নারীগ্রন্থ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা সভার আয়োজন হয়। সেখানে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুৎ-সংকট, অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মেগা প্রকল্পের প্রভাব, নারী নির্যাতন নিয়ে সভায় আলোচনা করেন অর্থনীতিবিদ, অধিকারকর্মী, গবেষক ও নারীনেত্রীরা। তাদের বক্তব্য থেকে বেশ কয়েকটি বিষয় বেশ স্পষ্ট। নারীর ওপর সামাজিকভাবে দুর্ভিক্ষ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে দুর্ভিক্ষ আমাদের কাছে আশঙ্কা, তা এখন নারীর কাছে রুঢ় বাস্তবতা। বিশেষত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীর জন্য তা যেন আরও সত্য। এখনও এমন কাঠামোর পরিবারে নারী পুরোপুরি স্বাধীন নয় তার ইচ্ছাপূরণের ক্ষেত্রে। এর মানে এই নয় নারী এখন ঘরের কোণে আটকে আছে। তাকে ক্রমেই ব্যতিব্যস্ত করে তোলা হচ্ছে। একসময় নারীকে কোণঠাসা করে রাখা হতো। দুর্ভিক্ষে নারীকে ঘরের কোণে কোণঠাসা করে রাখা হতো। তার বের হওয়ার সুযোগ ছিল না। তাকে কাজ দেবে কে? অথচ এখন যেন তার ঠিক উলটো। যুগের পরিবর্তনই এর জন্য দায়ী। নারী এখন বের হয়ে আসতে শুরু করেছে তার প্রয়োজনে। নারীকে অর্থনৈতিক একক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সমাজে অপরাধপ্রবণতা বাড়ছে। জীবনে মৌলিক চাহিদা সমাজের সব স্তরের মানুষ পাচ্ছে না। এ জন্যেই তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। নগরে যদি নিম্নবিত্ত পরিবারের নারীর সঙ্গে কথা বলা যায়, তাহলে একটি সাধারণ চিত্র দেখা যাবে। তাদের স্বামী আয় করে না। অথবা আয় করলেও তা পর্যাপ্ত নয়। আবার অনেকে তো একাধিক বিয়ের সম্পর্কে জড়িয়ে আছেন। সামাজিকভাবে এক ধরনের ব্যতিব্যস্ততা নারীর সামনে আছেই। তাই দুর্ভিক্ষ নারীকে বহুদিন ধরেই সামলাতে হচ্ছে।

নারী তার ইচ্ছাপূরণের জায়গায় স্বাধীন নয়। বাধ্য হয়ে তাকে কর্মক্ষেত্রে আসতে হয়। সে অবস্থাও কি ভালো? মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক নারী চাকরিজীবী হয়ে, উদ্যোক্তা হয়ে বা নানাভাবে আয়ের উৎস খুঁজে চলেছেন। সেখানে তারা সাফল্যও দেখাতে শুরু করেছেন। তারা একইসঙ্গে সংসার সামলাচ্ছেন। তারা একইসঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্র চালাচ্ছেন। নিম্নবিত্ত পরিবারের নারী যেহেতু বাধ্য, তাই সামঞ্জস্যতার প্রশ্নই আসে না। এই দুর্ভিক্ষ সামলাবে তারা কিভাবে? কোনো উপায় আছে কি? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, দায়িত্ব, নিজেকে দিনের পর দিন চালিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় নারীকে অসংখ্য সংকোচনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। তার সুস্থতার জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়ার টাকায় তিনি কাটছাঁট করছেন। নানাভাবে ভাড়ার টাকা বাঁচিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন, সঞ্চয় করছেন। আবার ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফিরে দায়িত্ব পালন করছেন। তার সঙ্গী হয়তো তাকে কিছুটা হলেও সাহায্য করছেন। তবে তা সার্বজনীন কিছু নয়। বিশেষত ভূমিকার দিক থেকে নারীর ওপর যে বাড়তি চাপ রয়েছে তা সরানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। দেশে চা-শ্রমিকের আন্দোলনের সময় নারীদের অগ্রণী ভূমিকা নিতে দেখা গেছে। তারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন, কারণ নারী চা-শ্রমিকের জীবন কতটা সংগ্রামমুখর তা ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে আমরা জেনেছি।

এমন আরও অনেক উদাহরণই টেনে আনা যায়। নারী এই মুহূর্তে এক দুর্ভিক্ষ সামলাচ্ছে। জাতীয় দুর্ভিক্ষের সময় নারীকে তার নিরাপত্তা বিকিয়ে হলেও অস্তিত্ব রক্ষা করতে হবে। যদিও আমরা আশা করি, এমন দুর্ভিক্ষ হবে না। নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু এ কথা মানতেই হবে, রাষ্ট্র এখনো নারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। নারীরা এ সমাজেরই অংশ। ফলে সমাজের সব ইস্যুই নারীর ইস্যু। না খেয়ে না ঘুমিয়ে প্রতিটি আন্দোলনে নারী অংশ নিচ্ছেন। নারীর এসব পদক্ষেপকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে দেখতে হবে। বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে নারীর জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতেই হবে। নয়তো এখন নারী যেভাবে সামলাচ্ছেন সব সামনে তা একেবারেই সম্ভব হবে না।

লেখক : সংবাদকর্মী।

Link copied!