• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ রমজান ১৪৪৫

তবু মেসিতেই ফুটবলের শান্তি


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১, ২০২২, ০৫:৩১ পিএম
তবু মেসিতেই ফুটবলের শান্তি

ওম শান্তি ওম! কথাগুলো বিশেষ কিছু কি? সৃষ্টিকর্তার কাছে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষের প্রার্থনাবাণী। সেটা আবার বিশেষ হবে কেন? হবে। যদি কোনো বিশেষ ব্যক্তি বিশেষ কাউকে নিয়ে ওই বাক্য উচ্চারণ করেন, তখন তাকে কী বলবেন!

হোসে মরিনহো নামের এক পর্তুগিজ ভদ্রলোক কোনো এক আর্জেন্টাইনকে ফুটবল বিশ্বে শান্তির দূত বলতে গিয়ে ও রকম কিছুই বলেছিলেন। মরিনহো ফুটবল বিশ্বে ‍‍‘স্পেশাল ওয়ান‍‍’ নামেই পরিচিত। ম্যান ইউ, রিয়াল মাদ্রিদের খ্যাপাটে মেজাজের সেই বিখ্যাত কোচ। বার্সেলোনার কাছে রিয়াল হেরে যাওয়ার পর বলেছেন, ‍‍‘মেসি গোল করলে ফুটবল শান্তি পায়!‍‍’ কিন্তু সেই মেসি পেনাল্টি থেকেও গোল মিস করলে! গোলাকৃতি বস্তুটার যতটা অশান্তি তার চেয়ে অশান্তির আগুনে পোড়েন মেসি-ভক্তরা।তারা কখনো আর্জেন্টিনা সমর্থক। কখনো বার্সা সমর্থক। কখনো পিএসজি সমর্থক। হ্যাঁ, মেসি বিশ্বকাপে পেনাল্টি থেকে গোল মিস করেছেন। এতে তিনি নিজে অনুশোচনা, অনুতাপের আগুনে দগ্ধ হলেও সেই আগুনের আঁচ খুব বেশিক্ষণ মেসি-ভক্তদের গায়ে লাগেনি! কারণ, তার দুই টিমমেট গোল করে বাঁচিয়ে দিয়েছেন মেসি আর আর্জেন্টিনাকে। পোল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ জিতে কাতার বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে আর্জেন্টিনা।

লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার মানুষের কাছে এক দুয়োরাণীর ছেলে! অভিমান করে আর্জেন্টাইনরা বলেন,‍‍ ‘মেসি দারুণ ফুটবলার। কিন্তু ওকে আমরা চিনি না।ও আমাদের না। দিয়েগো আমাদের।’ এই অভিমান কয়েক হাজার গুণ বেড়ে যেত যদি পোল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে বা ড্র করে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপের প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিত। কাতারের স্টেডিয়াম নাইন সেভেন ফোরের নীল-সাদা স্রোত থমকে যেত। আর মেসিও সমালোচনার তির বিদ্ধ হতেন। রক্তাক্ত হতেন।

কিন্তু বেঁচে গেলেন মেসি। মারণ উপত্যকায় এ পর্বে জয়ী হলো মেসি আর তার দল।তার একটা কারণ যদি হয় আর্জেন্টিনার দুই গোল, দ্বিতীয় কারণ অবশ্যই পোল্যান্ডের আলট্রা ডিফেন্সিভ অসুন্দর ফুটবল! সব মিলিয়ে মেসির বিশ্বকাপ স্বপ্ন বেঁচে রইল। পেনাল্টি থেকে মেসি গোলের সুযোগ হাতছাড়া করলেও আর্জেন্টিনা হাল ছাড়েনি। ভিএআর যে সুযোগ এনে দেয় মেসিকে সেই পেনাল্টি কতটা যুক্তিযুক্ত এবং নির্ভুল ছিল, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। তবে ফুটবল-ঈশ্বরের বিচারপ্রযুক্তির বিচারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাল। সেটা পোল্যান্ডের গোলকিপার শেজনির হাত দিয়ে! তিনি জানতেন মেসির বাঁ পা কী করতে পারে। কিন্তু ফুটবল বিশ্বকে দেখালেন শেজনির হাত বিশ্বকাপের প্রথম তিন ম্যাচের দুটিতেই পেনাল্টি বাঁচালেন! শুধু তা-ই নয়। পোলিশ গোলকিপারই পোল্যান্ডের শেষ ষোলোতে খেলার যে স্বপ্ন প্রায় কোমায় চলে যাচ্ছিল ডি মারিয়ার বাঁকানো কর্নার কিকে সেটাকে বের করে এনে অক্সিজেন দিলেন! তিনি পোল্যান্ডে শান্তি বজায়ে রাখলেন। স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখলেন। পোলিশ সমর্থক-ভক্তরাও গাইতে পারলেন,‍‍ ‘ওম শান্তি। ওম।‍‍’ মেসি বিশ্বকাপ ছুঁতে পারবেন কি না কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। কিন্তু খাদের কিনার থেকে ঘুরে দাঁড়ানো আর্জেন্টিনার ড্রেসিংরুমে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস!  ওম শান্তি ওম গাইছেন কি না তারা জানেন? ব্রিটিশ পত্রিকায় লিখেছে,‍ ‘আই ওয়াজ বর্ন ইন আর্জেন্টিনা, ল্যান্ড অফ দিয়েগো অ্যান্ড লিওনেল...‍‍’

এ গানের শেষ কথাগুলো হচ্ছে, ‍‍“বয়েজ, আই ওয়ান্ট টু বি দ্য ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন। অ্যান্ড উই ক্যান সি দিয়েগো ইন হ্যাভেন এনকারেজিং লিওনেল!‍‍’ তার মানে আর্জেন্টাইনদের কাছে ম্যারাডোনা ছিলেন। মেসি আছেন। তাই ওদের গ্যালারিতে নীল সাগরের ঢেউ ওঠে। মেসি পেনাল্টি মিস করার পরেও!
তবে এটাও ঠিক, জিনিয়াসরা সব সময় জেতে না। বিজ্ঞান আর মস্তিষ্ক তাদের হারিয়ে দিতে পারে। তবে প্রতিভা যখন জিততে শুরু করে, তখন কিছু করার থাকে না। মেসি, নেইমার, রোনালদো, এমবাপ্পে। এরা প্রতিভাবান। ওরা জিতলে বা দলকে জেতালে সেটা দেখতেও ভালো লাগে। বিশ্বকাপ ওরা প্রত্যেকেই জিততে চান। আবার বিশ্বকাপ তার জৌলুশ আর রোমাঞ্চ ধরে রাখতে ওদের চায়! মেসি-নেইমার-রোনালদোদের পায়ে বল চুম্বন খায়। ওরা কেউ এখনো বিশ্বকাপে চুমু খেতে পারেননি! পারবেন কি না কেউ জানেন না! তবে একটা কথা জানেন। কাতার বিশ্বকাপে জীবনের চু্ম্বন মেসি, নেইমার, রোনালদো। কেউ পেনাল্টি মিস করে। কেউ চোট পেয়ে মাঠ ছাড়ে। কেউ বল মাথায় না লাগলেও উল্লাসে ভাসে! এগুলো নিয়ে অন্তত কয়েক প্রজন্মকে বলতে পারবেন, আমি একসঙ্গে মেসি-রোনালদো-নেইমারকে বিশ্বকাপে দেখেছি। আমার চোখ তৃপ্ত হয়েছে। আর ফুটবল শান্তি পেয়েছে। এরা গোল করেছেন। গোল করিয়েছেন। আবার মিসও করেছেন!

মেসি পোল্যান্ডের বিপক্ষে পেনাল্টি মিস করেছেন। তবু সেই মিসের মর্মস্পর্শী বর্ণনা হবে না! কারণ, তার দল জিতেছে! আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে। তাদের সমর্থকরা মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে সেই মেসির দিকেই। পেনাল্টি মিস করার পরও!

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!