• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

শিক্ষায় অবাঞ্ছিত সাম্প্রদায়িকতা


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: নভেম্বর ৯, ২০২২, ১২:৩৮ পিএম
শিক্ষায় অবাঞ্ছিত সাম্প্রদায়িকতা

চলমান এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সাম্প্রদায়িক উসকানির তথ্য পাওয়া গেছে। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডে বাংলা প্রথমপত্রের সৃজনশীল প্রশ্নে এই সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দেওয়া হয় বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশ্ন ওঠার পর শিক্ষামন্ত্রী এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের পক্ষ থেকে জড়িতদের পরিচয় প্রকাশ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়েছে।

গত ৬ নভেম্বর বাংলা প্রথমপত্র পরীক্ষা দিয়ে সারা দেশে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হয়েছে। তাতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের প্রশ্নপত্রের সৃজনশীল অংশের প্রশ্নপত্রের ১১ নম্বর প্রশ্নে সনাতন ধর্মের দুই ভাইয়ের জমি নিয়ে বিরোধের বিষয় তুলে ধরা হয়। প্রশ্নে দেখানো হয়, “নেপাল ও গোপাল দুই ভাই। জমি নিয়ে বিরোধ তাদের দীর্ঘদিন। অনেক সালিশ-বিচার করেও কেউ তাদের বিরোধ মেটাতে পারেনি। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। এখন জমির ভাগ বণ্টন নিয়ে মামলা চলছে আদালতে। ছোট ভাই নেপাল বড় ভাইকে শায়েস্তা করতে আব্দুল নামে এক মুসলমানের কাছে ভিটের জমির এক অংশ বিক্রি করে। আব্দুল সেখানে বাড়ি বানিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। কোরবানির ঈদে সে নেপালের বাড়ির সামনে গরু কোরবানি দেয়। এই ঘটনায় নেপালের মন ভেঙ্গে যায়। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে জমি-জায়গা ফেলে সপরিবারে ভারতে চলে যায় সে।” এরপর প্রশ্ন করা হয়—(ক) মিরজাফর কোন দেশ হতে ভারতে আসেন; (খ) ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব।—ব্যাখ্যা কর; (গ) উদ্দীপকের নেপাল চরিত্রের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলা নাটকে মিরজাফর চরিত্রের তুলনা কর; (ঘ) খাল কেটে কুমির আনা। প্রবাদটি উদ্দীপক ও সিরাজউদ্দৌলা নাটক উভয়ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। উক্তিটির সার্থকতা নিরূপণ কর।

উদ্দীপক ও প্রশ্নের পরতে-পরতে সাম্প্রদায়িকতা জড়িয়ে। হিন্দু ধর্মাবলম্বী দুই ভাইয়ের বিরোধ, ভাই ভাইকে শায়েস্তা করতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী একজনের কাছে জমি বিক্রি, ইসলাম ধর্মাবলম্বী লোকটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাড়ির সামনে গোরু জবাই করা, মন ভাঙা হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ভিটেমাটি ছেড়ে ভারত চলে যাওয়া—এগুলোই মূলত বার্তা উদ্দীপকে। যেখান থেকে প্রশ্নে আবার আনা হয়েছে বিশ্বাসঘাতকতার স্মারক হিসেবে পরিচিত মিরজাফর চরিত্রকে। ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের বিশ্বাসঘাতকতা দেখানো হয়েছে, দেখানো হয়েছে আন্তঃপরিবার বিবাদকে, দেশান্তরের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে যেখানে পারিবারিক দুঃখবোধ।

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের আন্তঃপরিবার বিবাদের কারণে দেশান্তরের যে ইঙ্গিত এখানে দেওয়া হয়েছে, সেটা দেশীয় অবস্থার সঙ্গে মেলে না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীর বাড়ির সামনে মুসলমানের গোরু কোরবানি দেওয়াকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীই নয়, মুসলমানদেরও আঘাত দেওয়া হয়েছে। কারণ সুস্থ চিন্তার কেউ সাধারণত এমনটা করে না। তবে এসব যে হয় না তা না, দুর্বৃত্ত মানসিকতার প্রবল প্রতিক্রিয়াশীলদের দ্বারা এসব হয় মাঝেমাঝে, যদিও সংখ্যায় তা কম।

উদ্দীপকের সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর যারা খুঁজবে তাদের বয়স কত? উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী হিসেবে আঠারোর কাছাকাছি। এই বয়সের শিক্ষার্থীদের মনে ধর্মীয় বিরোধকে যেভাবে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, সেটা অনুচিত। এটা যদি জেনেবুঝে কোনো শিক্ষক করে থাকেন তবে তার শিক্ষকজীবনই বৃথা বলে মনে করি। যারা কৈশোরের মনস্তত্ত্ব এবং ধর্মীয় বিভেদ সম্পর্কে সম্যক ধারণা না রাখেন, তবে তারা শিক্ষার্থীদের শেখাবেন কী?

ঢাকা শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার প্রশ্নপত্রে জড়িতদের যে তথ্য দিয়েছেন তাতে দেখা যাচ্ছে প্রণয়নকারী ও পরিশোধনকারীদের প্রত্যেকেই সহকারী ও সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেছেন যশোর শিক্ষাবোর্ডের অধীন ডা. সাইফুল ইসলাম ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক প্রশান্ত কুমার পাল। প্রশ্নপত্র পরিশোধনকারী হিসেবে ছিলেন নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ তাজুদ্দিন শাওন, সাতক্ষীরা সহকারী মহিলা কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শফিকুর রহমান, নড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের সহকারী অধ্যাপক শ্যামল কুমার ঘোষ এবং কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা আদর্শ কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. রেজাউল করিম। ধর্মের দিক থেকে এই পাঁচজনের মধ্যে আছেন হিন্দু ও ইসলাম দু-ধর্মেরই লোক। শিক্ষকদের পরিচয় নিয়ে ধর্মীয় বিভক্তি টানার উদ্দেশ্যে এখানে আমার না, এটা অযৌক্তিকও। এখানে তাই আলোচনার দাবি রাখে শিক্ষক হিসেবে তাদের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিষয়টিই।

এই পাঁচ শিক্ষকের তিনজন মুসলমান এবং দুজন হিন্দু; এটাই তাদের মূল পরিচয় নয়। তারা যে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে অক্ষম, সেটাই মূল কথা। এটা ক্ষয়ে যাওয়া আমাদের শিক্ষক-সমাজের একটা উদাহরণ হতে পারে। ধর্মীয় সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে এমন বিতর্কিত প্রশ্ন প্রণয়ন ও পরিশোধনে তাদের কি একটুও ভাবতে ইচ্ছা হলো না এইধরনের প্রশ্নে কী প্রভাব পড়তে পারে শিক্ষার্থীদের? এমন না যে একটা মাত্র হাত দিয়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন হয়। এটা হয় অনেকগুলো ধাপ অতিক্রম শেষে। একজন না হয় ভুল করতে পারে, কিন্তু একই ঘটনায় পাঁচ-পাঁচজন বিষয়টি কীভাবে এড়িয়ে গেল? এখানে অদক্ষতার পাশাপাশি কি দায়িত্বে অবহেলা থাকছে না?

কেবল এইচএসসি পরীক্ষার এ প্রশ্নপত্রেই নয়, পাবলিক অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে আমরা এমন উসকানিমূলক অনেক কিছুর অস্তিত্ব দেখতে পাচ্ছি। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েও এমন ঘটনা এখন নিয়মিত হতে চলেছে। একেক ঘটনার পর কিছু আলোচনা হয় সামাজিক মাধ্যমে, এরপর এসবের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার খবর পাওয়া যায় না বলে শিক্ষাক্ষেত্রের এ নৈতিক দৈন্য দিন দিন প্রকট হয়ে ওঠেছে। আশার কথা এবার খোদ শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, বলছেন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। শিক্ষাবোর্ড তাৎক্ষণিক প্রশ্নপত্রের সঙ্গে জড়িতদের পরিচয় প্রকাশ করেছে। এসব ঘটনায় এবার অন্তত মনে হচ্ছে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।

বছর-বছর প্রতি পাবলিক পরীক্ষা শেষে কৃতকার্য শিক্ষার্থীদের কথা আমরা জানতে পারি। কোন বোর্ডে পাসের হার কত বাড়ল, কত কমলো সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা করি। জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের গল্প শুনি। বিপরীতে আবার তাদের নিয়ে হতাশা ও আক্ষেপের গল্পও শুনি। দোষটা প্রায়ই দিয়ে যাই শিক্ষার্থীদের। কিন্তু আমরা কতজন খবর রাখি কী শিখছে তারা, যারা শেখানোর দায়িত্বে তারা কতখানি তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন, কী তাদের যোগ্যতা? এইচএসসি পরীক্ষায় সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক এই প্রশ্নপত্র শিক্ষকদের নিয়ে প্রশ্নের সুযোগ করে দিয়েছে। শিক্ষার্থীর মনস্তত্ব সম্পর্কে ধারণা না রাখা এ শিক্ষকেরা যে সংবেদনশীল বিষয়ে কতখানি অসংবেদনশীল তার বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে!

পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণের বিরুদ্ধে আমরা বারবার বলছি। রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সাম্প্রদায়িকীকরণে যে পথের রচনা হয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া আমাদের উপায় নেই। কেবল পাঠ্যবইকে অসাম্প্রদায়িক করলে হবে না, শিক্ষক সমাজকেও নিয়েও ভাবতে হবে। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং এরপর সার্বক্ষণিক তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে হবে তাদের।

শিক্ষার্থীদের সঠিক শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিতের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সরকারের উচিত সঠিক শিক্ষাদানের জন্যে নিয়োজিত শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তোলা। সাধারণ শিক্ষা ধর্মীয় শিক্ষা নয়। ধর্মীয় শিক্ষার পথ অন্য, প্রতিষ্ঠানও ভিন্ন। সাধারণ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোথাও উচিত না সাম্প্রদায়িক উসকানিমূলক কিছু উপস্থিতি ঘটানো। যেখানে সাম্প্রদায়িকতা, সেখানে উসকানি, সেখানেই কঠোর হোক রাষ্ট্র।

 

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

Link copied!