• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ, ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ৮ রমাজান ১৪৪৫

জীবনের মূল্য আমরাই-বা কতটুকু দিই?


তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২২, ০৮:২৮ এএম
জীবনের মূল্য আমরাই-বা কতটুকু দিই?

দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সহজে মেনে নেওয়া যায় না। কিন্তু মনকে বুঝ দেওয়ার জন্যই লোকে মিথ্যা সান্ত্বনা দেয়, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’, ‘যার যখন মৃত্যু হবার, তখনই হবে’, ‘তার মৃত্যু ওই সময়ে, ঐভাবেই কপালে লেখা ছিল’ এমনই সব কথা বলে। এমনকি ‘হায়াত মউত আল্লাহর হাতে’ এই কথা বলেও নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে বিপজ্জনকভাবে লোকে রাস্তা পার হয়। অথচ এটা একবারও চিন্তা করে না, তার অসচেতনতার জন্য হয়তো নিরপরাধ কোনো বাসচালকের শাস্তি হয়ে যেতে পারে।

কিছুদিন আগে ১১ তরুণ মারা গেলেন ট্রেন ও মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে। অথচ তারা একটু ধৈর্য ধরলেই দুর্ঘটনা ও মৃত্যু এড়াতে পারতেন। কিংবা উত্তরায় গার্ডারের নিচে চাপা পড়ে যে ৫ জন নিহত হলেন, এটি পরিষ্কার হত্যাকাণ্ড। কর্তৃপক্ষের কাজের গাফিলতিতে এ মৃত্যু। অথচ সামান্য সদিচ্ছা থাকলেই মৃত্যুগুলো এড়ানো যেত।

আচ্ছা, ধরেই নিলাম, তাদের মৃত্যু ওই মুহূর্তে কপালে লেখা ছিল। তবু ধৈর্য ধরে ওই ১১ তরুণ মাইক্রোবাসে বসে থাকতেন। মাইক্রোর ভেতরে না হয় চুপচাপ স্বাভাবিক মৃত্যু হয়ে যেত! তবু দুর্ঘটনা অবশ্যই এড়ানো যেত। কিংবা কর্তৃপক্ষ গার্ডার ওঠানোর সময়ে রাস্তায় যান চলাচল কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখলেই হতো। তাদের মৃত্যু যদি কপালে আগেই লেখা থাকে, তবু গাড়িতে চুপচাপ মরে পড়ে থাকত। তবু ওই গার্ডারের নিচে তো পড়তে হতো না।

মোবাইলে কথা বলতে বলতে বা ইয়ারফোন কানে গুঁজে গান শুনতে শুনতে রাস্তা পার হতে গিয়ে কতজন দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনা অবশ্যই এড়ানো যায়।

সামান্য দূরে চলন্ত যানবাহন বা ট্রেন দেখার পরও, সামনে দিয়েই নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হচ্ছে মানুষ। এমনকি নিজের সন্তানের প্রাণের তোয়াক্কা না করেই যানবাহনের সামনে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছেন। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের ত্রিশালে বাবা, মা ও সন্তান রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ল। আর গর্ভবতী মা ওই মুহূর্তে সন্তান প্রসবও করে ফেললেন। সড়কের এই দুর্ঘটনার জন্য আসলে কাকে দায়ী করবেন? পথচারীরা নিজেও দায়ী অনেক ক্ষেত্রে। অথচ এসব দুর্ঘটনা একটু সতর্ক হলেই এড়ানো যায়।

একমাত্র রোগে ভুগে ও স্বাভাবিক মৃত্যু হলে ‘হায়াত মউত আল্লাহর হাতে’ এ ধরনের কথা খাটে। অন্যথায় চিকিৎসকের ভুলে, খুনের মাধ্যমে, সড়ক দুর্ঘটনায় বা অন্য যেকোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুতে এসব কথা খাটে না, খাটে না, খাটে না। কেননা, এই প্রতিটি মৃত্যুই এড়ানো সম্ভব। এমনকি সতর্ক থাকলে, আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যেও ইদানীং প্রাণ রক্ষা করা যায়।

প্রতিটি দুর্ঘটনা ও অস্বাভাবিক মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। দুর্ঘটনায় প্রতিটি প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। এজন্য নাগরিকদের মধ্যে দরকার সচেতনতা। আরও চাই অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।

কিন্তু ওই সব পুরোনো বস্তাপচা ডায়লগ ‘যখন মৃত্যু হবার তখন হবেই’, ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছে’, এগুলোর চর্চা যদি চলতে থাকে, তবে অপঘাতে মৃত্যুগুলোও স্বাভাবিক হতে থাকবে। এবং সত্যিই তাই হচ্ছে। এ কথাগুলো খুনিকে ফেভার করে। যেন কেউ আপনার পেটে ছুরি চালিয়ে বলছে, ‘আপনার হায়াত শেষ হয়ে গেছে, তাই মরলেন।’ অথচ অপঘাতে মৃত্যুর জন্যও শাস্তির বিধান আইন ও ধর্মীয় ব্যবস্থায় রয়েছে। শরিয়া আইনে তো হত্যার শাস্তি রীতিমতো মৃত্যুদণ্ড! ‘আল্লাহর মাল যদি আল্লাহই নিয়ে থাকেন’ তবে এখানে শাস্তির বিধান কেন, একটু ভেবে দেখুন। বিধান এ জন্যই যে, এ মৃত্যুগুলো অস্বাভাবিক, এগুলো এড়ানো সম্ভব।

‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই’ কথাটা মনে হয়, এখনকার বোধবুদ্ধিহীন অসচেতন মানুষগুলো বোঝে না। বোঝে না বলেই, সব মৃত্যুই আজকাল আমাদের কাছে স্বাভাবিক লাগে। তাই হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ‘হায়াত মউত আল্লাহর ইচ্ছা’ বলে খুনিদের রক্ষা করা হয়। বিচারহীনতার একটি সংস্কৃতি এভাবেই তৈরি হয়। আমাদের জীবনের দাম এভাবেই সস্তা হতে থাকে দিন দিন।

যদি নিজের জীবনের মূল্য সত্যিই বুঝতে পারেন, তবে চিৎকার করে বলুন, ‘আমি কারও হাতে খুন হতে চাই না। বাস ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মরতে চাই না। গুম হতে চাই না। লঞ্চ ডুবে মরতে চাই না। কারও চাপিয়ে দেওয়া ডিপ্রেশন সইতে না পেরেও আত্মহত্যা করতে চাই না। চিকিৎসকের ভুল চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে থাকতে থাকতে একসময় মরে যেতে চাই না। কারও দেওয়া অতিরিক্ত মানসিক চাপ আর টেনশনে স্ট্রোক করে আয়ু ক্ষয় করতে চাই না। প্রতিদিন ভেজাল আর অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে খেয়ে নিজেকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিতে চাই না।’

আমি স্বাভাবিকভাবে মরতে চাই। আমাকে স্বাভাবিকভাবে মরতে দিন। স্বাভাবিকভাবে মরতে পারাটাই হবে আমার জীবনের চূড়ান্ত ও একমাত্র সফলতা।

Link copied!