• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

গণমাধ্যম, দর্শকের রুচি ও অপরাধপ্রবণতা প্রসঙ্গে


তানিয়া কামরুন নাহার
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৪, ২০২২, ১০:২৯ এএম
গণমাধ্যম, দর্শকের রুচি ও অপরাধপ্রবণতা প্রসঙ্গে

ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ‘ক্রাইম প্যাট্রল’ খুব জনপ্রিয় প্রোগ্রাম। আমি কখনো দেখিনি, তাই জানি না, এখানে ঠিক কী দেখানো হয়। সারা বিশ্বেই এখন ক্রাইম থ্রিলার জাতীয় অনুষ্ঠান বা ওয়েব সিরিজ বেশ জনপ্রিয়। বিদেশের অনুকরণে আমাদের দেশেও এখন এরকম অনুষ্ঠান, নাটক, ওয়েব সিরিজ নির্মাণ বাড়ছে। এ ধরনের অনুষ্ঠান দেখে আইডিয়া নিয়ে দেশে অভিনব সব উপায়ে হত্যাকাণ্ডও কিন্তু দিন দিন বাড়ছে।

ক্রাইম পেট্রোল না দেখলেও এর আদলে নির্মিত বাংলাদেশি কিছু টিভি অনুষ্ঠান আমার দেখা হয়েছে। পুরো অপরাধের ঘটনা একেবারে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে এখানে দেখানো হয়। কেন এভাবে অপরাধগুলোকে দেখানো হয়?

১। অপরাধীকে হাতে কলমে অপরাধ করার ১০১টি কলাকৌশল শেখানোর জন্য?
২। দর্শকদের সচেতন করিয়ে দেওয়ার জন্য?

আসলে এ দুটোর কোনোটাই নয়। অনুষ্ঠান নির্মাতারা নিজেদের টিআরপি বাড়ানোর জন্যই এরকম ভায়োলেন্স ও অপরাধের কলাকৌশল নিয়ে অনুষ্ঠান করে থাকেন। শুধুমাত্র অপরাধের ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনারও কিছু পত্রিকা বিক্রি হয়। তাতে ধর্ষণের ঘটনাগুলো খুব রগড় করে লেখা থাকে। ধর্ষণের শিকার নারীর নাম, পরিচয় সব প্রকাশ করা হয়। কোন শ্রেণির পাঠক এরকম পত্রিকা নিয়মিত পড়ে থাকেন, বলাই বাহুল্য। এরকম পত্রিকা নিয়মিত পড়ে বিকারবিহীন থাকা আমার কাছে কঠিন বলেই মনে হয়। সেই সঙ্গে টিভিতে কিংবা ওয়েব সিরিজের ক্রাইম থ্রিলার বা এ ধরনের অনুষ্ঠানে যদি এসবের ভিজ্যুয়ালাইজেশন হয়, তবে এর প্রভাব তো নিঃসন্দেহে আরও বেশি।

এসব অনুষ্ঠান দেখে এক শ্রেণির দর্শক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অতি সচেতন হবে হয়তো, কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হবে না। কারণ আরেক শ্রেণির দর্শক এগুলো থেকে আইডিয়া পেয়ে আরও বেশি করে অপরাধ ঘটাচ্ছে। বাংলাদেশে অনুষ্ঠান দেখায় দর্শকের বয়সও বিবেচনা করা হয় না। হয়তো প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত ক্রাইম থ্রিলার নিতান্ত শিশুও তার পরিবারের সঙ্গে বসে দেখছে। ফলে কিশোর অপরাধের ঝুঁকিও বাড়ছে।
মনে রাখতে হবে, দর্শকের হাতে রয়েছে রিমোট কন্ট্রোল, ইন্টারনেট। কোনো অনুষ্ঠান ভালো না লাগলে জোর করে তা দেখার দায় তার নেই। তাই সে চলে যায় ভিনদেশি অনুষ্ঠান ‘ক্রাইম পেট্রোল’ দেখতে। এ অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ও চাহিদার কথা বিবেচনা করে আমাদের দেশেও এর অনুকরণে নকল অনুষ্ঠান নির্মিত হচ্ছে, যেখানে অপরাধের সব বিবরণ বিস্তারিতভাবে প্রচার করা হয়ে থাকে।

অপরাধের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনার চেয়ে বরং এরকম অপরাধ করলে দেশের আইনে কী ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে, এসব নিয়ে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান বেশি দরকার। এছাড়া অপরাধীদের শাস্তি পাওয়ার উদাহরণগুলোও অনুষ্ঠানে তুলে ধরা দরকার। 
তবে এইখানে এসে কবিকে একটু নীরব হতেই হচ্ছে। অপরাধ করে কয়জন অপরাধীর শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়?

একটা খুন/ ধর্ষণ বা অপরাধের পর পত্রিকায়, টিভিতে কয়েকদিন মাত্র এসব নিয়ে নিউজ হয়। টিআরপি ভালো থাকে যতদিন, ততদিনই নিউজ হয়। এরপর সব হারিয়ে যায়। আমরা দ্রুত ভুলে যাবো ফারদিন নুরের হত্যাকাণ্ডের শেষ পর্যন্ত বিচার হলো কিনা। এই যে ছোট্ট শিশু আয়াতকে খণ্ড বিখণ্ড করা হলো, নিজের ঘরে খুন হলো অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী অদিতা, সেই সব খুনিদের শেষ পর্যন্ত কী শাস্তি হলো, হলো কি হলো না, আমরা সব ভুলে যাবো। আবার কোনো ফারদিন খুন হবে, আয়াত খুন হবে, অদিতা খুন হবে নিজের ঘরে নিজ শিক্ষকের হাতে, তখন আবার হৈ চৈ হবে। ব্যস, এই তো!

কিন্তু খুনিদের শাস্তি কি হবে আদৌ? সেইসব ‘ক্রাইম পেট্রোল’, ‘তালাশ’, ‘ঘটনার ভেতরে ঘটনা’ অনুষ্ঠানগুলো কোথায়, যেখানে অপরাধীদের শাস্তির বর্ণনা দেওয়া থাকে? একটি অপরাধের পর কীভাবে অপরাধীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে যায়, ভুক্তভোগীর জীবনে কী বেদনা নেমে আসে, এসব কেন দেখানো হয় না? বাংলার মানুষ তো এতটা অবিবেচক নয়। একসময় নাটক দেখে দর্শকরা বাকের ভাইয়ের মুক্তি চেয়ে মিছিল করতো। এখন সেই একই দর্শক অনুষ্ঠান দেখে খুন/ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধ করে সাইকোপ্যাথের মতো।

তবে কি দর্শকের রুচির মান কমে গেছে, নাকি অনুষ্ঠানের মান কমে গেছে? যেন ডিম আগে না মুরগি দ্বন্দ্ব। এক সময় তো বিটিভির বিজ্ঞাপন দেখেও মানুষ অনেক বিষয় সম্পর্কে সচেতন হতো। এখন কি বিজ্ঞাপনের মতো একটি ভালো, তথ্য সমৃদ্ধ, মানসম্মত সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যায় না? শুধু ক্যালকুলেটরে অনুষ্ঠানের টিআরপির হিসাব করলেই চলবে? অথচ গণমাধ্যম পারে দর্শকের রুচি তৈরি করে দিতে। গণমাধ্যমকে সেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমাদের গণমাধ্যম সে দায়িত্ব পালন করছে না বলেই দর্শকেরা ভিনদেশি অনুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে। বাড়ছে অপরাধ, কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না।

লেখক : শিক্ষক ও লেখক।

Link copied!