• ঢাকা
  • সোমবার, ১৪ জুলাই, ২০২৫, ৩০ আষাঢ় ১৪৩২, ১৮ মুহররম ১৪৪৬

দেবশিশুর মাথায় ঈশ্বরের হাত, পায়ে জাদু


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৪, ২০২২, ০৩:২৯ পিএম
দেবশিশুর মাথায় ঈশ্বরের হাত, পায়ে জাদু

‍‍‘দেবশিশু ’ ইমেজ নিয়েই তার ফুটবল গ্রহে ঘোরাঘুরি। মধ্য ত্রিশের সেই শিশুর মাথার ওপর যেন ‍‍‘হ্যান্ড অব গড‍‍’! হ্যাঁ, ফুটবল ঈশ্বরের হাতটা মনে হচ্ছে তার মাথায় ওপর। আর তাতেই দেবশিশুর রূপান্তর পৌরষদীপ্ত এক যোদ্ধায়! যিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ফুটবলীয় সাফল্যের শেষ সীমান্ত জয়ের জন্য। তার আগে একের পর এক সীমানা জিতছেন। দলকে নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়াই করছেন। টিমমেটদের সঙ্গে কথা বলছেন। গ্যালারির সামনে গিয়ে দর্শকদের তাতিয়ে তুলছেন। নিজে গোল করছেন। গোল করাচ্ছেন। টিমমেটদের সঙ্গে সেই মূহুর্তগুলো দারুণভাবে উদ্‌যাপন করছেন। আগে বাজে ট্যাকেলের শিকার হয়েও মাথা নিচু করে থাকা সেই যুবক এবার রেফারির চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ছেন এটা কী হলো! প্রয়োজনে তর্ক করছেন। গণমাধ্যমের সামনে দাঁড়িয়ে রেফারি থেকে প্রতিপক্ষ কোচের সমালোচনা করতেও  ছাড়ছেন না! এ যেন আর্জেন্টিনার ১০ নম্বর জার্সিধারী স্বর্গবাসী সেই ‍‍‘ফুটবল ঈশ্বরে‍‍র’ প্রতিবিম্ব! এই লিডার লিওনেল মেসিকে কি আগে দেখেছে আর্জেন্টিনা! কিন্তু এই মেসিকেই তো তারা খুঁজে বেড়িয়েছেন।লিডার মেসি। জাদুকর মেসি। যার নেতৃত্ব আর জাদুতে কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা।

অথচ কাতার বিশ্বকাপ শুরু করল তারা সৌদি আরবের কাছে হার দিয়ে। তারপর কত প্রশ্ন! কত সমালোচনা! কিন্তু একটাই উত্তর দিয়েছিলেন মেসি। ‍‍‘আমরা বিধ্বস্ত। মৃত না! জানি গ্রুপ পর্বেই এখন আমাদের সব ম্যাচ নক আউট।‍‍’ সত্যিই তাই। যেকোনো ম্যাচ হারলেই ফাইনালে খেলার স্বপ্ন শেষ হয়ে যেত আর্জেন্টিনার। কিন্তু একের পর সীমান্ত জয় করে মেসি এবং তার দল কাপযুদ্ধের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে। আর মাত্র একটা ম্যাচ জিতলেই ফুটবলের প্রান্তিক স্টেশনে নেমে পড়বেন মেসি কাপ হতে। অবসান হবে আর্জেন্টিনার তিন যুগ অপেক্ষার। প্রবল মুদ্রাস্ফীতি আর দারিদ্র্য ভুলে উৎসবে মেতে উঠতে পারবে তারা। একটু ভুল বলা হলো মনে হচ্ছে। শুধু আর্জেন্টাইনরা কেন, বিশ্বের কোটি কোটি মেসি-ভক্তরাও হয়তো দিন গুনছেন মুহূর্তটির জন্য।

মেসির হাতে বিশ্বকাপ। এবং আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন। এই স্বপ্ন যদি ১৮ ডিসেম্বর বাস্তব হয়ে ফিরে আসে তাহলে অনেক বিতর্কের মীমাংসা হয়ে যাবে। অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে। মেসি সমকালীন ফুটবলের মহানায়ক? নাকি তিনি সর্বকালীন মহানায়কদের অন্যতম। ম্যারাডোনা পেরেছেন, তুমি কেন পারো না! আর্জেন্টাইনদের অভিমানজাত এই প্রশ্নও আর থাকবে না। মেসি তুমি আমাদের দেশে জন্মেছো। কিন্তু তুমি আমাদের না। বার্সেলোনার। আমাদের হচ্ছে দিয়েগো! হতাশা আর অভিমানে যারা লিওনেল মেসিকে ভূমিপুত্রের স্বীকৃতি দিতে চান না, তারাও কিন্তু গাইতে শুরু করেছেন, ‍‍‘আমরা দিয়েগো, লিও‍‍’র দেশের...! দিয়েগো স্বর্গ থেকে লিওকে দেখছে।..ওরা যুদ্ধ করছে...! দিয়েগো আর লিওকে একই লাইনে বসাতে শুরু করেছেন। তারা বিশ্বাসও করছেন পারলে লিওই পারবেন।

 

বিশ্বাস করবেন না কেন! এই ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সেমিফাইনালে কী দেখল ফুটবল বিশ্ব? আর্জেন্টিনার চেয়ে অনেক বেশি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলতে শুরু করল ক্রোয়েশিয়া। মেসিকে আটকানোর জন্য জনাকয়েক ক্রোয়েটের একটা প্যাট্রল টিম করা হলো। মেসির আশপাশে সারাক্ষণ তারা। লুকা মদরিচ আর অন্যরা মিলে দারুণ সব পাস খেলতে শুরু করলেন। আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ আর রক্ষণভাগের ওপর ভয়ংকর চাপ তৈরি হলো। কোথায় আর্জেন্টিনার ল্যাটিন ফুটবল! কোথায় কি! চোখের জন্য তৃপ্তিদায়ক মনে হচ্ছিল ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিং ফুটবল। কিন্তু তারপর সবকিছুই মায়া আর ভ্রম, এটা মনে করিয়ে দিয়ে পেনাল্টি আদায় করে নিল আর্জেন্টিনা। মদরিচ মায়ায় আচ্ছন্নদের মোহাবিষ্ট করে পেনাল্টি থেকে গোল করলেন মেসি। গ্যালারিতে আওয়াজ উঠল, মে- সি, মে-সি, মে-সি! মেসি ম্যানিয়ার মাঝে আলভারেজ যা করলেন, আর ফুটবল বিশ্ব যা দেখল তাতে একটা প্রজন্মকে ফিরে যেতে স্মৃতির রথে ছিয়াশির মেক্সিকো বিশ্বকাপে। সেখানে চলে এলেন ফুটবল ঈশ্বর স্বয়ং। নিজেদের হাফ থেকে বল নিয়ে একের পর এক ইংলিশ ফুটবলারাদের ডজ দিয়ে ম্যারাডোনার সেই শতাব্দীর সেরা গোল। আলভারেজ ৫৫ গজ দূর থেকে বল নিয়ে যে দৌড় দিলেন এবং জনাদুয়েক ডিফেন্ডার আর গোলকিপারকে কাটিয়ে যে গোল করলেন, দেখার জন্য ফুটবলে এ রকম ভালো মুহূর্ত কটা পাবেন! ম্যারাডোনার ছিয়াশির গোল, নব্বইয়ে ইতালিতে রবার্তো ব্যাজ্জিওর গোলটার পাশে রেখে আপনাকে দেখতে হবে একে। খুব সংক্ষেপে—অসাধারণ। অবিশ্বাস্য। অবিস্মরণীয়। যে ক্রোয়েশিয়া নিজেদের মধ্যে আঠারোটা পাস খেলার পর ওই গোল হজম করল, তাদের জন্য একটাই সান্ত্বনা বাক্য। ফুটবল টিম গেম। কিন্তু ইনডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স এক মুহূর্তে দুমড়েমুচড়ে ছারখার করে দিতে পারে আপনার স্বপ্নকে। আলভারেজ তাই করলেন। রিচার্লিসনের অ্যাক্রোবেট সেই গোলের কথা মাথায় রেখেও বলতে হবে, কাতার বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত এটাই হয়তো সেরা গোল।

 

কিন্তু মেসি নামক একজন তখনো মাঠে। ইন্ডিভিজুয়াল ব্রিলিয়ান্স কী তার আরেক ঝলক দেখালেন পঁয়ত্রিশের সেই যুবক। টেলিভিশনে গোটা বিশ্বের চার শ কোটি মানুষের আট শ কোটি চোখ যা দেখতে চেয়েছিল নিজের বাঁ পা দিয়ে মেসি সে কাজটাই করলেন। বাঁ দিক থেকে বল নিয়ে তিনি জাদুকরের মতো ক্রোয়েশিয়ার বক্সে ঢুকলেন। গোল লাইনের কাছ গোলমুখে মাইনাস করলেন। তারপর আলভারেজ যা করার তাই করলেন। স্কোরশিটে লেখা থাকবে আলভারেজের নাম। কিন্তু সেই গোল আসলে মেসির বাঁ পায়ের জাদু!

 

এই মেসিকে দেখে কে বলবেন মধ্য ত্রিশে দাঁড়িয়ে এই লোকটা! এর আগের চারটে বিশ্বকাপ ব্যর্থতা যেন তাকে শক্তি জোগাচ্ছে এবার শ্রেষ্ঠত্বের মহড়া দেওয়ার জন্য। আসলে মেসি কী? কেউ বলছেন, জিনিয়াস!  আবার ইউরোপীয় মিডিয়া বলতে শুরু করেছে ‍‍‘মেসি মোর দ্যন গোলস‍’! সত্যিই গোল দিয়ে মেসিকে মূল্যায়ন করতে গেলে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে আর্জেন্টিনার তৃতীয় গোলটাকে কী মনে হবে আপনার!

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!