• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

ঈশ্বরপুত্র নেইমারহীন ব্রাজিলও অসাধারণ!


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২২, ০৪:২৭ পিএম
ঈশ্বরপুত্র নেইমারহীন ব্রাজিলও অসাধারণ!

নেইমারহীন ব্রাজিল জিততে পারে। সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে জিতেছেও। স্কোর লাইন তাই বলছে। ব্রাজিলের এই জয়টা মাঠে বসে দেখেছে কাকা-কার্লোস-কাফু-রোনালডো। ম্যাচের সময় টিভি পর্দায় একাধিকবার ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী সাবেক চার তারকাকে দেখানো হয়েছে। একসময় ফুটবল মাঠে দ্যুতি ছড়ান চার তারকা এক ফ্রেমে। সেই ফ্রেমটা কোনো ক্যামেরাপারসন মিস করতে চাননি। ফ্রেমটাকে ইনসার্ট হিসেবে ব্যবহার করায় দর্শকরা ভেসেছেন ফুটবলীয় রোমান্স আর নস্টালজিয়ায়। কিন্তু ব্রাজিল-সুইজারল্যান্ড ম্যাচের সময় ওই মুখগুলোতে কত রকম অভিব্যক্তি! সংশয়, হতাশা, আনন্দ, উচ্ছ্বাস দ্রুত খেলা করেছে  মুখগুলোতে! ম্যাচ শেষে স্বস্তি।ব্রাজিল জিতেছে।

 কিন্তু ব্রিটিশ একটা দৈনিকে যা লেখা হয়েছিল, সেটা যদি সত্যি হয়, তাহলে একটা উত্তর ব্রাজিল সমর্থকেরা, কাকা, আপনারা কাছে জানতে চাইতে পারেন, নেইমারকে ছাড়া ব্রাজিল কেমন খেলল! আপনি সার্বিয়া ম্যাচের পর বলেছিলেন, ‍‍‘নেইমার মাঠ ছাড়ার পর ব্রাজিল অসাধারণ ফুটবল খেলেছে।‍‍’ আপনার ভাষায় ওটাই ব্রাজিল দলটার ইতিবাচক দিক। কিন্তু সুইসদের বিপক্ষে আপনি কি সেই ইতিবাচক দিকটা খুঁজে পেলেন! 

কাকা সেই বিরলদের একজন। যিনি বিশ্বকাপ জিতেছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছেন। ব্যালন ডি’অর জিতেছেন। নিজে আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার ছিলেন। নিজে ব্রাজিলের হয়ে গোল করেছেন। গোল করিয়েছেন। তিনি যখন বলেন, নেইমার মাঠ ছাড়ার পর অসাধারণ ফুটবল খেলেছিল ব্রাজিল, তাহলে নেইমারকে ছাড়া দলটা ভালো ফুটবল খেলবে, সেটা আশা করা ভুল ছিল না। কিন্তু সত্যিই ব্রাজিল ভালো ফুটবল খেলল কি?
কাকা, আপনার কথা পড়ার পর ব্রাজিলের এই ম্যাচটা দেখে বছর দুয়েক আগে স্বর্গবাসী হওয়া এক দার্শনিককে মনে পড়ছে। তিনি দার্শনিক। ডাক্তার। বিপ্লবী। সংস্কারক। জীবনে চলার পথে ফুটবলও খেলেছেন। আপনাদের মতো বিশ্বকাপ জেতেননি। তবে বিশ্ব ফুটবলের হৃদয় জিতেছিলেন। আশির দশকে তার পোস্টার সাঁটা থাকত ছাত্রছাত্রীদের পড়ার ঘরে। সব বয়সী মানুষকে দুলিয়ে দিয়েছিলেন জাদুকরি ফুটবল দিয়ে।  হ্যাঁ, আপনাদের মতো তিনিও হলুদ রঙের ব্রাজিলয়ান জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন। বিশ্বকাপে ব্রাজিলের মতো ফুটবল হিসটিরিয়ার দেশের অধিনায়কত্ব করেছেন।

ব্রাজিলের এই ম্যাচ দেখার পর স্বর্গে বসে সিগারেট টানতে টানতে তিনি নিজের সেই কথাটাই বলছেন কি! ‍‍‘আমরা ব্রাজিল। সুন্দর ফুটবলের দেশ। আমাদের জিততে হবে মানুষকে আনন্দ দিয়ে। সেই ফুটবলের কী মানে, যা মানুষের মনে থাকবে না! সেই জয়ের অর্থ কী যা মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারে না।‍‍’
কিন্তু প্লেটোর বই হাতে নিয়ে খেলা দেখতে বসে নেইমারহীন এই ব্রাজিলের খেলা দেখেে কি ভদ্রলোক বইয়ের পাতায় বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েছিলেন? ব্রাজিল অধিনায়ক হয়েও যিনি জীবনের রাস্তাতেও ছিলেন দার্শনিক। জীবনের আদর্শ বলতে  পেলে গারিঞ্চাকে বাদ দিয়ে দুটো নাম বলতেন, চে গেভারা আর জন লেনন। ও হ্যাঁ, তার নিজের নামটাই তো বলা হয়নি। অবশ্য তার পুরো নাম লিখতে গেলে ব্রাজিলের প্লেয়ার লিস্টের অর্ধেক জায়গা চলে যায়। সক্রেটিস ব্রাসিলেরো সাম্পাইয়ো দে সুজা ভিয়েরা দে অলিভিয়েরা। বিশ্বফুটবল তাকে এক নামেই চিনেছে- সক্রেটিস। যেমন চেনে নেইমারকে। পেশায় ডাক্তার ভদ্রলোক পায়ে বল নিয়ে হয়ে উঠতেন মাঝমাঠের অসাধারণ শিল্পী। হলুদ জার্সি পরে মাঠে তিনি ছিলেন চলমান পদ্য। তিনি ফুটবল খেলতেন না। ছবি আঁকতেন।  বল ছিল তুলি। মাঠ ছিল ক্যানভাস। তিনি বিশ্বাস করতেন ব্রাজিলের ফুটবল মানে কোটি মানুষের হৃৎস্পন্দন। বিশ্বকাপে হারের যন্ত্রণা থাকলেও খেলার ধরন নিয়ে আক্ষেপ ছিল না। কিন্তু নেইমারহীন ব্রাজিলের এই ম্যাচটা দেখলে আক্ষেপে  হয়তো দু‍‍’প্যাকেটের জায়গায় তিন প্যাকেট সিগারেটও শেষ করতেন কি না কে জানে!

কোনো সন্দেহ নেই ব্রাজিলের এই দলে প্রতিভাবান ফুটবলারে ভরা। কিন্তু নেইমার তো একজন।  বল পায়ে অবিশ্বাস্য কিছু করে দেখানোর ক্ষমতা আছে যার। তার পা অন্য রকম দ্যুতি ছড়ায়। যা মন থেকে ডিলেট করা কঠিন। কারণ, নেইমারদের ফুটবল মানুষের হৃদয়ে ফুল হয়ে ফোটে। ফাউল নামের কাটার আঘাতে তাদের রক্তাক্ত করা যায়। মাঠ থেকে বের করে দেওয়া যায়। কিন্তু মানুষের হৃদয় থেকে নেই হয়ে যান না নেইমাররা। নেইমার সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‍‍‘আমি ঈশ্বরপুত্র। ঈশ্বর যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কোথায় জন্ম নেবেন আবার। আমি বলব, ব্রাজিলে। কারণ, ব্রাজিল মানে ফুটবল। আমি ফুটবল খেলতে চাই।‍‍’ মাঠে ফেরার জন্য ছটফট করছেন নেইমার। সে আভাসও আছে তার পোস্টে। ‍‍‘আমি ফিরতে চাই ব্রাজিলের জন্য। আমার টিমমেটদের জন্য। আমাকে মারার জন্য আমার শত্রুদের আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না।‍‍’ এই নেইমার আলাদা জায়গা পাচ্ছেন ফুটবলপ্রেমীদের কাছে। 

বিশ্বকাপ না জিতেও ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয় জুড়ে যেমন আছেন দার্শনিক সক্রেটিস। ব্রাজিল হয়তো অনেক আগেই সক্রেটিসদের ফুটবল দর্শন ছুড়ে ফেলেছে। কিন্তু ব্রাজিল মানে শৈল্পিক ফুটবল ঘিরে আবেগের রোমান্স।

 

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

Link copied!