দলটার দিকেও একটু মন দিন সাকিব


অঘোর মন্ডল
প্রকাশিত: অক্টোবর ১১, ২০২২, ০২:২২ পিএম
দলটার দিকেও একটু মন দিন সাকিব

বাংলাদেশ ক্রিকেটের টি-টোয়েন্টি আকাশে জমা নিম্নচাপ যেন কাটছেই না। বরং বেশি ঘনীভূত হচ্ছে! নিউজিল্যান্ডে তিন জাতি টুর্নামেন্টের প্রথম দুই ম্যাচ দেখে শঙ্কা বাড়ছে। বিশ্বকাপে দলের এই ছন্নছাড়া চেহারার বদল হবে কি? সন্দিগ্ধ মন ইতিবাচক কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।

কর্কশ শোনালেও সত্যি, সাফল্যকেই মনে রাখে সবাই। ব্যর্থতা বাসের টিকিটের মতো জীবনকে পিষে চলে যায়। ব্যর্থতা যে বাংলাদেশ দলের পিছু ছাড়ছে না। বিশেষ করে ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম সংস্করণে।

বিশ্বকাপের দল নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলছেন। মতামত দিচ্ছেন। আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। সেটাকে আরও বেশি উসকে দিয়েছে  তিন জাতি টুর্নামেন্টে পাকিস্তান ও নিউজিল্যন্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশ দলের পারফরম্যন্স। দুটো ম্যাচই বাংলাদেশ হেরেছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লম্বা সিরিজ খেলে করাচি থেকে ক্রাইস্টচার্চ পৌঁছানো পাকিস্তানের বিপক্ষে তা-ও কিছুটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার আঁচ ছিল। পরের ম্যাচে নিউজিল্যন্ডের বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাংলাদেশ দলের কাছে অন্য গ্রহ থেকে আসা কোনো শব্দ মনে হয়েছে! সামান্যতম লড়াই ছিল না।

লড়াই বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য পরিকল্পনা লাগে। বাংলাদেশ দলে সেটার খুব অভাব। তারুণ্যনির্ভর এই দলের ক্রিকেটারদের ভেতর ইনবিল্ট অনেক কিছু আছে। স্কিল। ট্যালেন্ট। সংকল্প। কিন্তু তার সঙ্গে দরকার মন। বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সে সেই মনটাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! মাঠে তাদের শারীরিক ভাষা, চাল-চলন দেখে মনে হয়, খানিকটা নো-নেটওয়ার্ক জোনের মধ্যে রয়েছেন তারা। সব আছে। সব হচ্ছে। কিন্তু খেলাটার সঙ্গে মনের সংযোগ ঘটছে না!

এই নেটওয়ার্ক জোনের বাইরে চলে যাওয়া ক্রিকেটারদের মনটাকে খেলার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়ার কাজটা দলের টিম ম্যানেজমেন্টের। দলের সঙ্গে কনসালট্যান্ট আছেন। আছেন টিম ডিরেক্টর। তাদের কাজ নিশ্চয়ই ফ্লাইটের টিকিট, হোটেল রুম কনফার্ম করা নয়। কিন্তু শ্রীরাম শ্রীধরন-খালেদ মাহমুদ সুজন কী করছেন, সেটা বোঝা আরও কঠিন। তার চেয়ে কঠিন দলের অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের ভূমিকা বোঝা। তিনি দলের অধিনায়ক। অথচ অধিনায়ক দলের সঙ্গে প্র্যাকটিস করলেন না। দলের সঙ্গে তার যোগাযোগই ছিল না। কারণ, তিনি তখন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে ব্যস্ত! বিসিবি তাকে অনাপত্তিপত্র দিয়েছেন এই লিগ খেলার জন্য। সাকিব তাই তিন জাতি টুর্নামেন্ট শুরুর আগে থেকেই দলের নেটওয়ার্ক বাইরে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন নিউজিল্যান্ড পৌঁছালেন। প্রথম ম্যাচ খেলতে পারলেন না। পরের ম্যাচ খেললেন। কিন্তু দলের অধিনায়কই ব্যাট করতে নামলেন সাত নম্বরে! দলের সব থেকে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার যদি ব্যাটিং অর্ডারে এত পেছনে নিয়ে যান, তাহলে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অধিনায়ক সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবেন কীভাবে? যা হওয়ার তাই হয়েছে। সাকিব ব্যর্থ। হঠাৎ দলের সঙ্গে যোগ দিয়ে দলটাকে এক সুতায় বেঁধে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেওয়া কঠিন। সাকিব কেন, যেকোনো অধিনায়কের জন্যই সেটা কঠিন।

সাকিব যদি সিপিএলকে বেশি গুরুত্ব দেবেন, তিন জাতি টুর্নামেন্টের চেয়ে, তাহলে তাকে টুর্নামেন্ট থেকেই ছুটি দিতে পারত বিসিবি। আত্মপক্ষ সমর্থনে বিসিবির কাছ থেকে অনেকগুলো ‘যদি’, ‘কিন্তু’ মার্কা উত্তর পাওয়া যাচ্ছে! ট্রানজিট ভিসা জটিলতা। কানেকন্টিং ফ্লাইট না পাওয়া! ইত্যাদি ইত্যাদি!

অধিনায়কের এ রকম হেঁয়ালিপনা দলের অন্যদের সীমাহীন উদ্যম আর স্বপ্নের দফারফা করে দেয়। দল একের পর এক ম্যাচ হারলে দলের তরুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী ক্রিকেটারদের মনও থেঁতলে যায়। নিজেদের উদ্যম ঝলসে যায়! সেটা দেখা গেল দ্বিতীয় ম্যাচে আট নম্বরে ব্যাট করতে নামা দলের সহ-অধিনায়ক উইকেট কিপার ব্যাটার সোহানের ১২ বলে অপরাজিত ২৫ রানের ইনিংসে। টিম ক্র্যাশ করলে ও রকম ইনিংসও মূল্যহীন মনে হয়।

কনসালট্যান্ট, টিম ডিরেক্টর, বোর্ড সভাপতি, সবাই বলছেন, ভালো খেলো, ভালো খেলো, কিন্তু ক্রিকেটাররা নির্দিষ্ট জীবনচর্চার মধ্যে আছেন কি না, সেটা দেখবেন কে? যদি দেখার কেউ থাকতেন তাহলে অধিনায়ক কি আর টুর্নামেন্ট শুরুর আগের দিন টিমের সঙ্গে যোগ দেন!

দলের সাফল্যের জন্য দেশের মানুষ উন্মুখ হয়ে থাকে। প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকে তাদের মন। ব্যর্থতার নেটওয়ার্কের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে তারা যেন এখন ক্রিকেটে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছেন! ক্রিকেট দেখতেও এখন নাকি অনেকের মন চায় না!

সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের মনের একটা সংযোগ তৈরি করে দেবেন কে! আসলে সাফল্য শুধু মাঠের এগারোজন ক্রিকেটারের পারফরম্যান্সের ওপর নির্ভর করে না। সঙ্গে দরকার টিম ম্যানেজমেন্ট, বোর্ড, সবার সম্মিলিত পারফরম্যান্স। এই তিন টিমের পারফরম্যান্স একসঙ্গে ভালো না হলে, ক্রিকেট নিয়ে আমাদের হাহাকার বাড়বে। ব্যর্থতার ইতিহাস ভারী হবে। আমরা সাফল্যের নেটওয়ার্কের বাইরে দূর থেকে দূরবর্তী কোন প্রান্তে চলে যাব। যা আমরা যেতে চাই না।

 

লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট

Link copied!