হাওয়া দেখার পরে


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: আগস্ট ২১, ২০২২, ০৯:৪৬ এএম
হাওয়া দেখার পরে

অবশেষে আমি ‘হাওয়া’ দেখলাম। অনেক পরেই দেখা হলো আমার। শ্যামলীর এক রাতের শোতে দেখা হলো। হলভর্তি সেদিন মানুষ, রাত আটটার শো। তখন হাওয়ার ট্রেন্ড কিছুটা কমছে। তবুও সেদিন ছিল প্রচুর নারী দর্শক। শ্যামলী হলের মতো একটা মাঝারি মানের হলে, এত মানুষ দেখলেও কেমন জানি লাগে। আমি এর আগে শ্যামলী হলে যে ছবি দেখেছিলাম সেটা ছিল, ‘রেহানা মরিয়ম নূর’। শুক্রবার দুপুরে শো দর্শক ছিল মেরে কেটে পাঁচজন। ওরকম ফাঁকা হলেও সিনেমা দেখার আনন্দ আছে। মনে হয় নিজের বাসায় বসে দেখছি।

তো ‘হাওয়া’ দেখার পর সবার যে প্রবণতা দেখলাম, সেটা হলো ভালো বলার। সিনেমাটা অবশ্যই ভালো। কিন্তু সবার ভালো লাগবে এটা আমি বিশ্বাস করি না। এসব আর্ট কালচারের ক্রিটিসিজম থাকবেই। কিন্তু মানুষের কথা শুনলে মনে হয় ভালো বলার ‘মিশন’ নিয়ে নেমেছে। ‘হাওয়া’ ভালো ছবি, তবে তার দু একটা যে খামতি নেই, সেটা বলার লোক কম।

মনে করার চেষ্টা করি ‘হাওয়া’ খুবই টেকনিক্যালি সাউন্ড একটা সিনেমা। সিনেমা যেহেতু একার কাজ নয়, এখানে প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্ট ভালো করতে হয়। মেকআপ, কস্টিউম থেকে শুরু করে পানির নিচের চিত্রগ্রহণ সব দারুণ। বাংলা চলচ্চিত্রে আপনি সবকিছু এরকম পারফেক্ট পাবেন, এটাই অবিশ্বাস্য। এরকম আউটডোরে সাগরের ভেতরে সিনের কন্টিনিউটি রাখাই টাফ। চঞ্চল চৌধুরীর পান খাওয়া দাঁত থেকে শরীফুল রাজের ইঞ্জিন রুম বড় পর্দায় দেখতে সব দারুণ।

যে অভিনেতারা ছিলেন তাদের এখন মানুষ চিনে, হাওয়ার সময় তারা হয়তো এত চেনা লোক ছিলেন না। এদের সবাই ফাটিয়ে অভিনয় করেছেন। চঞ্চল চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন, তাঁকে যখন অ্যাপ্রোচ করা হয়, তখন নাকি তিনি বাদে আর তারকা নাই। কাজটা করবেন কিনা নিশ্চিত হয়েছেন আগে।

এই ছবির গান তো মুখে মুখে, হলে লোকজন একটু নাচার ট্রাই করলো। আমার মনে পড়লো নবারুণ ভট্টাচার্যের একটা আলাপ, ‘বাঙালি ভাসানের সময় একটু কেওড়ামি করে, ব্যস, that‍‍’s all, সে নাচটা নাচে না। বোম্বের গণেশ পুজোতেও হয় এই এক। বাঙালি একটি নাচবিহীন জাতি।’ সিনেমাটা প্রথম দিকে স্লো ছিল। আর জেলে জীবনের আরও কিছু অনুষঙ্গ দেখাতেই পারতো, মাটির জীবনের যে ডিটেইলিং শুরু হয়েছিল, তা আরেকটু চললে ক্ষতি কী ছিল?

তবে সেকেন্ড হাফ যখন শুরু হলো তখন থ্রিলটা এলো। কিন্তু হল ভর্তি মানুষ কুচকাওয়াজের আওয়াজের মতো চিপস আর পপকর্ন খাওয়ার শব্দে একটু বিরক্ত লাগছিল। তার ভেতরে কেউ মোবাইলের টর্চ পরীক্ষা করে। এই সিনেমার প্রাণ এই শেষ পার্টটুকুই। ঘটনাগুলো দ্রুত ঘটে যাচ্ছে আর জনরা শিফটিং চলছে, এই কারণে দর্শকদের দেখলাম একটু বিরক্তও। তবুও কিছু পুরুষালি জোক ও গালাগালিতে মানুষ অনেক হেসেছে। অনেকে গালাগাল নিয়ে হতাশ। আমি তাদের ভেতরে নেই। এরকম গালি যাপিত নাগরিক শহুরে জীবনেই আছে। যারা বিরক্ত, তারা কোনো আইসোলেশনে থাকে জানি না। শেষের দিকে শেষ হতেও একটু সময় নেয়, দর্শকরা বাসায় ফেরার তাড়না অনুভব করেন। কারণ অনেকের বাসার গেইট রাতে বন্ধ হতে পারে, সাড়ে দশটা বেজে যাচ্ছে। আমাদের যে বিপন্নতা তো অদ্ভুত। সিনেমার শেষে ভেবেছিলাম মেঘদলের গানটা থাকবে। একটু হতাশ হলাম। তাড়া নিয়ে নামতে গিয়ে আমরা অনেকেই অন্য একটা পথ দিয়ে নেমেছি। তখনও মাথায় হাওয়ার সেই মিস্ট্রি।

‘হাওয়া’ সিনেমার যে জিনিসটা ভালো লাগেনি সেটা হলো সরল রৈখিক গল্প। আমরা ওটিটি দেখা মননে যে ধরনের থ্রিল আশা করি, ‘হাওয়া’ তেমন নয়। ‘হাওয়া’ নিয়ে যত জায়গায় আলাপ করেছি এই ব্যাপারটা সবাই বলেছে। তবে মেজবাউর রহমান সুমনের পক্ষে, তার প্রথম ছবিতে তিনি বাংলা ছবির ট্রাডিশনটাই রেখেছেন। এটা এক ধরনের ট্রিবিউটও হতে পারে। সিনেমাটা দেখা শেষে মনে হয়েছে তোজাম্মেল হক বকুলের কথা। ভদ্রলোক বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই খুশি হতেন। আর ‘হাওয়া’ ছবির আরেকটা জিনিস ভালো লাগেনি। সেটা হলো, সংলাপ আর ভালো হতে পারতো। তবে প্রথম ছবি হিসেবে মেজবাউর রহমান যে ‘স্ট্যান্ড’ করেছেন তাতে সন্দেহ নেই।

আমার কিছু বন্ধু সিনেমাটা দেখেছে। তাদের হলে যথেষ্ট মানুষ ছিল। দিনশেষে মানুষের ভালোবাসাই শেষ কথা। আর ‘হাওয়া’ একটি জনবান্ধব সুন্দর ছবি। সেটা রংপুরে শাপলা হলে হোক, আর শ্যামলী হলে হোক, মানুষের নিজের মনে করে সিনেমায় অংশগ্রহণই আসল ব্যাপার।

লেখক : ফ্রিল্যান্স রাইটার ও এক্টিভিস্ট।

Link copied!