রাজধানী এবং এর বাইরে মিলিয়ে প্রায় ৫০০ নারী সাংবাদিক আছেন। অনির্ধারিত সূত্র অনুযায়ী, এই সংখ্যা আরও বেশি। কারণ বিভিন্ন গণমাধ্যমে কর্মরত ওই সব নারী এই সংগঠনের সদস্য নন। তবে এ থেকে একটি সাধারণ ধারণা পাওয়া যায়। সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির মতো বড় সংগঠনগুলোতে যেসব নারী সাংবাদিক সদস্য হিসেবে আছেন, তাদের সবাই আবার এই সংগঠনের সদস্য নন। আবার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সংগঠন জাতীয় প্রেসক্লাবের যারা সদস্য তারা সবাই এই তালিকায় না-ও থাকতে পারেন।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) জাতীয় প্রেসক্লাবের জহুর হোসেন চৌধুরী হলে জাতীয় প্রেসক্লাব আয়োজিত আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ‘স্বাধীনতার ৫০ বছরে সাংবাদিকতায় নারী’ শীর্ষক আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা জানান বিশেষ সংবাদদাতা ও ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মাহফুজা জেসমিন।
তিনি জানান, মার্চ ২০২০ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত কোভিড ১৯ মহামারির প্রাদুর্ভাবে গণমাধ্যম থেকে যারা কাজ হারিয়েছেন, তারা অনেকেই এখনো কাজে ফিরে আসতে পারেননি। সাংবাদিকতায় ফিরে আসার জন্য তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এই পরিস্থিতি অবশ্য নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই সমভাবে প্রযোজ্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছে। প্রথমে খুব ধীরে ধীরে নিভৃতে হলেও ক্রমশ পরিবর্তন দ্রুততর হয়েছে। ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে কয়েকজন নারী সাংবাদিকতা বা সংবাদপত্রের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ছিলেন? তারা নিঃসন্দেহে সবার কাছে কিংবদন্তি হয়ে রয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তাদের হাত ধরে, কখনো তাদের দূর থেকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে নারীরা সাংবাদিকতায় এসেছেন। অবশ্য একটি কথা খুব নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, বাংলাদেশে নারীদের সাংবাদিকতায় অংশগ্রহণের যাত্রাটা কয়েক দশকের পুরোনা হলেও সরাসরি সাংবাদিকতা, রিপোর্টিং, অ্যাসাইনমেন্ট কাভার, এসব কিন্তু এসেছে শেষ তিন দশকে। বিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের শুরুতেই একবিংশ শতাব্দীর যাত্রার ধ্বনি আমরা শুনতে পেয়েছি। একই সঙ্গে পরিবর্তনগুলোও দেখতে পেয়েছি।
মাহফুজা জেসমিন বলেন, বাংলাদেশে নারী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ নূরজাহান বেগম সম্পাদিত বেগম পত্রিকা সাংবাদিকতায় নারীর অগ্রযাত্রায় মাইলফলক। বাংলাদেশের সাংবাদিকতায় নারীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ থেকে সম্পাদনা সবকিছুই শুরু হয়েছিল তাঁর হাত ধরে। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় উপমহাদেশের নারী সাংবাদিকতারও পথিকৃৎ তিনি। বেগম পত্রিকাই দেশের প্রথম সচিত্র নারী সাপ্তাহিক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নারী জাগরণ, নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকারের কথা নারী সমাজের কাছে পৌঁছানো হতো।
১৯৪৭ সালে ‘বেগম’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বেগম পত্রিকার প্রথম সম্পাদক ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। তিনিই ছিলেন প্রধান সম্পাদক। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ শিক্ষানুরাগী বেগম রোকেয়ার ছবি। প্রথম চার মাস কবি সুফিয়া কামাল বেগম পত্রিকার সম্পাদনা করেন। শুরু থেকেই বেগম পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন নূরজাহান বেগম। পরবর্তী সময়ে নূরজাহান বেগম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পান। কলকাতার ১১ ওয়েলেসলি স্ট্রিটের সওগাত প্রেসের অফিসে বেগম পত্রিকার যাত্রা শুরু হলেও দেশ বিভাগের পর ১৯৫০ সালে বেগম পত্রিকার অফিস ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৪ সালে বেগম পত্রিকাকে ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে বেগম ক্লাব। এটিই বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্লাব। বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর সভাপতি হয়েছিলেন বেগম শামসনাহার মাহমুদ এবং সাধারণ সম্পাদক নুরজাহান বেগম। কবি সুফিয়া কামাল ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। এই ক্লাবই নারী লেখকদের একত্রিত ও সংযুক্ত করতে নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করত। প্রথম দিকে মাসে একবার করে সভা বসত। পরে তা বছরে। একবার হয়। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এই ক্লাব চলমান ছিল। বেগম পত্রিকার মধ্যে দিয়েই নূরজাহান বেগম নারীর মতামত যেমন তুলে এনেছেন। তেমনি তাদের আত্মসচেতন, সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বেগম-এর মাধ্যমেই নারী জাগরণ ও নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে গেছেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রথম নারী আলোকচিত্রী সাইদা খানম বেগম পত্রিকার মাধ্যমেই তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি একাধারে ডেইলি অবজারভার, মর্নিং নিউজ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদসহ বিভিন্ন পত্রিকায় আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেন।
নারী সাংবাদিকতায় বহুল আলোচিত নাম বেবী মওদুদ ১৯৬৭ সাল থেকে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। তিনি দৈনিক সংবাদ, সাপ্তাহিক ললনা, দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক মুক্তকণ্ঠে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। তিনি বিবিসি বাংলা সার্ভিসের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বাংলা বিভাগ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে তিনি সাপ্তাহিক বিচিত্রার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমে সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তাসমিমা হোসেন ১৯৮৮ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত অনন্যা নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকার সম্পাদনা করেন। তিনি ২০১৪ সালে দৈনিক ইত্তেফাকের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের চার বছর পর ২০১৮ সালে ইত্তেফাকের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
গণমাধ্যমে নারীদের টিকে থাকার চ্যালেঞ্জ
• গণমাধ্যমগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি কম এবং যোগ্যতা উপেক্ষিত।
• সাংবাদিকতা পেশার উচ্চ পদে নারীর সংখ্যা কম। এ ক্ষেত্রে নারীর যোগ্যতার চেয়েও লিঙ্গ পরিচয়টি বড় হয়ে দেখা দেয়। কারণ, নারীর অধস্তন হিসেবে কাজ করার মানসিকতা এখন তৈরি হয়নি।
• রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রী বা অন্যান্য ডিআইপির গুরুত্বপূর্ণ বিদেশ সফরে নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয় না বললেই চলে।
• ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন পান না অনেক নারী সাংবাদিক। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের নারী সাংবাদিকরা বেশি বঞ্চনার শিকার।
• হাতে গোনা কয়েকটি সংবাদপত্র ও বেসরকারি চ্যানেল ছাড়া নারীকে কূটনৈতিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিট দেওয়া হয় না।
• জেন্ডার সমতা ও সাম্যের নীতি অনুসরণ করা হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
• নারী সাংবাদিকদের উন্নয়নে সাংবাদিক সংগঠনগুলোর কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেই।
• সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা নারী সাংবাদিকদের পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত করে। অনেকে আবার পেশায় এসেও ফিরে যেতে বাধ্য হন।
• সংবাদপত্রগুলোতে পরিবহন সুবিধা না থাকায় নারীরা পথে ঘাটে নানা রকম হয়রানির শিকার হন।
• গণমাধ্যমগুলোতে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ বিশেষ করে ওয়াশরুম, রেস্টরুমের ব্যবস্থা নেই। যে কারণে মাতৃত্বকালীন অনেক নারীকেই চাকরি ছেড়ে দিতে হয়।
• অধিকাংশ পত্রিকা অফিসে নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পায় না। আবার যেসব হাউসে মাতৃত্বকালীন ছুটি দেওয়া হয় তা-ও পুরো ছয় মাসের জন্য নয়। অনেকে মাতৃত্বকালীন ছুটিতে গিয়ে তার চাকরি হারান।
• গণমাধ্যম হাউসগুলোতে জেন্ডার সেনসিটিভ কর্মপরিবেশ তৈরির উদ্যোগ খুবই কম।
গণমাধ্যমে নারীর এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হলে যেসব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন:
• গণমাধ্যমের জন্য জেন্ডার সংবেদনশীল সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন।
• নারী হিসেবে নয়, সাংবাদিক হিসেবে তাদের যোগ্যতাকে মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা করতে হবে। জন্য সরকারি, বেসরকারি ও সাংবাদিক নারী সাংবাদিকদের নিয়োগ, প্রশিক্ষণ, পদোন্নতির ইউনিয়ন পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ।
• দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে নারী সাংবাদিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া। নারী সাংবাদিক সংগঠনগুলোর মধ্যে ঐক্য বজায় রাখা।
• যোগ্যতা অনুযায়ী সব বিটে নারী সাংবাদিকদের অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
• নারী সাংবাদিকদের যোগ্যতা তদারকির দায়িত্ব পালন করবে বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল।
• নারী সাংবাদিকরা চাকরি হারালে ও প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হলে প্রেস কাউন্সিলে বিনা খরচে মামলা করার সুবিধা থাকা।
• প্রতিটি হাউসে নারী সাংবাদিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি নিশ্চিত করা।
• সর্বশেষ (নবম) ওয়েজবোর্ড অনুযায়ী বেতন প্রদানের ব্যবস্থা থাকা।
• প্রতিটি সংবাদমাধ্যমের নিজস্ব আচরণবিধি প্রণয়ন। প্রত্যেক হাউজে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠন করতে হবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। গত ১৩ বছরে নারীদের যেই অগ্রগতি হয়েছে, এটি পৃথিবীতে উদাহরণ। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। নারীদের অবদান অসামান্য। গার্মেন্টস পণ্য যারা উৎপাদন করে তাদের অধিকাংশই নারী। প্রায় ৫০ থেকে ৬০ লাখ নারী গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত। যত কাজ হয় পৃথিবীতে তার ৭০ ভাগ কাজ করে নারী। নারীর অগ্রগতির মধ্যে দিয়েই সমাজ ও দেশের উন্নয়ন হয়। আমাদের দেশের নারীরা পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে। সাংবাদিকতায় নারীরা আজকে যেভাবে এগিয়ে আসছে, কয়েকজন নারী যখন ক্যামেরা নিয়ে ছুটোছুটি করে তখন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। তবে এ ক্ষেত্রে প্রাইভেট চ্যানেলের অবদান অনেক। দেখা যায় প্রাইভেট চ্যানেলে বহু নারী রিপোর্টার ভালো প্রতিবেদন করেন। বর্তমানে প্রায় ৩৬টি প্রাইভেট চ্যানেল রয়েছে। অনেক বড় পত্রিকার সম্পাদক এখন নারী।”
তথ্যমন্ত্রী বলেন, “যেসব দেশে নারীরা পিছিয়ে, তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পিছিয়ে আছে। আজকের নারীরা আরও এগিয়ে যেতে পারত যদি বিগত সরকার নারীদের নিয়ে কাজ করত। সব ক্ষেত্রে এই সরকার নারীদের অগ্রগতির জন্য কাজ করছে। বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় প্রায় সাড়ে ৪ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। নারী প্রগতির মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।”
অনুষ্ঠানের শুরুতে মোমবাতি প্রজ্বালন করা হয়। এতে সাবেক ডাকসুর প্রথম নারী ভিপি অধ্যাপক মাহফুজা খানমকে সম্মাননা পদক প্রদান করা হয়।
আলোচনায় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, মানবজমিনের সম্পাদক মাহবুবা চৌধুরী, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরুল আহসান বুলবুল, ডাকসুর প্রথম নারী ভিপি মাহফুজা চৌধুরী, দৈনিক আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাছিমা খান মন্টি প্রমুখ।