নিত্যপণ্যের বাজারে গত এক বছরে দফায় দফায় বেড়েছে প্রতি লিটারে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। ১১০ টাকা লিটারের তেল বছরের ব্যবধানে বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা করে। টিসিবির হিসাবে এই সময়ে প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে তেলের দাম। বারবার ভোজ্য তেলের দাম এভাবে বাড়ানোয় নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম হয়েছে। সাধারণ মানুষের ভাষ্য, ধনী শ্রেণি আর ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষায় ব্যস্ত সরকার। অন্যদিকে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, মানুষের আয় বাড়েনি, অথচ জিনিসপত্রের দাম ঠিকই বাড়ছে। শুধু ভোজ্য তেলে নয়, সব জিনিসের দামই বাড়ছে।
সম্প্রতি ব্যবসায়ীদের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেলের নতুন দাম নির্ধারণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। নতুন দাম নির্ধারণের পর প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেল ৮ টাকা বাড়িয়ে ১৬৮ টাকা এবং খোলা সয়াবিনে ৭ টাকা বাড়িয়ে ১৪৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া বোতলজাত সয়াবিনের ৫ লিটারের দাম ৩৫ টাকা বৃদ্ধি করে ৭৯৫ এবং পাম তেলের দাম কেজিতে ১৫ টাকা বৃদ্ধি করে ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এর বাইরেও ধাপে ধাপে খোলা বাজারে ভোজ্যতেলের এমন লাগামছাড়া দাম বৃদ্ধিতে ক্ষোভ দেখা যায় নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে। তারা জানান, কয়েক দিন পরপর নিত্যপণ্যের এমন দাম বাড়ায় প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে তাদের। তেলের এমন ঊর্ধ্বগতিতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তি আছেন দিন আনা খেটে খাওয়া মানুষেরা। তাদের দাবি, প্রতিদিন যা আয় করেন, তা দিয়ে বাসা ভাড়া ও পরিবারের খরচ চালানো কঠিন।
রাজধানীর বাংলামোটর এলাকায় কথা হয় রিকশাচালক রহমত আলীর সঙ্গে। সংবাদ প্রকাশকে তিনি জানান, গত চার বছর ধরে তিনি ঢাকায় রিকশা চালান। সাত সদস্যর পরিবারের দায়িত্ব তার কাঁধে। রিকশা চালিয়ে যা আয় করেন, তা প্রতিদিন রিকশা ও গ্যারেজ ভাড়া ও নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ রেখে গ্রামে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দিতে হয়। কিন্তু গত কয়েক মাসে নিত্যপ্রয়োজনীয় দাম বাড়ায় তার সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
হাতিরপুল বাজারে আসা বেসরকারি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “তেলের দামসহ সকল নিত্যপণ্যর দাম বাড়ায় আমরা এখন খাওয়া-দাওয়া অর্ধেক করে ফেলছি। প্রতিদিন দাম বাড়ছে, এই ব্যাপারে সরকারের কোনো মাথা ব্যথা নেই।” আক্ষেপের স্বরে তিনি আরো বলেন, “অপেক্ষা করেন, আর কয়দিন পর দেশে দুর্ভিক্ষ লাগবে। আমাদের না খেয়ে মরা লাগবে।”
হাতিরপুল এলাকায় এ বিষয়ে কথা হয় সাবেক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকরিজীবী হাবিব হোসেনের সঙ্গে। সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে দেশের বাজারেও বাড়বে। তবে করোনা ও সাধারণ মানুষের আয়ের দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকার ভর্তুকি দিয়ে তা জনগণের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখলে, ভালো হতো। এছাড়াও যেসব পণ্যের দাম ও উৎপাদন খরচ কম রয়েছে, তা ন্যায্যমূল্যে প্রাপ্তি নিশ্চিত করা দরকার।”
কারওয়ান বাজার আল্লাহর দান ডিপার্মেন্টাল স্টোরের কামাল হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “প্রতিদিন কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়ছে। মাসের সোমবার পর্যন্ত সয়াবিন তেল বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা লিটার। আর এখন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকা প্রতি লিটার। এছাড়া কয়েক দিনের ব্যবধানে দেশি মসুর ডাল কেজিপ্রতি ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২০ টাকায়।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি তেল ব্যবসীরা আজমত আলী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত সয়াবিনের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ায় দেশে দাম বাড়ছে। তবে যেভাবে দাম বাড়ছে, তাতে আগামী রমজানের আগেই ২০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।”
তাই সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে সরকারের কাছে ভ্যাট-ট্যাক্স তুলে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন তারা।
এদিকে ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, নতুন নির্ধারিত তেলের দাম আবার পুনর্বিবেচনা করা উচিত। করোনায় আয় কমে যাওয়াসহ চাকরি হারিয়েছে লাখ লাখ মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে এই দাম কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
প্রয়োজনে আমদানিনির্ভর এমন জরুরি ভোগ্যপণ্যের কর হ্রাস করে হলেও তা ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার দাবি তার।
গোলাম রহমান আরও বলেন, “সাধারণ মানুষের কথা ভেবে ব্যবসায়ীরা চাইলে কিছু কম লাভ করে দাম কমাতে পারতো। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, অনুযায়ী ভ্যাট-ট্যাক্স কিছুটা কমিয়ে দিলে, দাম কমানো যেতে পারে। কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ট্যাক্স কমালে সেটার সুফল অনেক সময় বাজারে পড়ে না। ব্যবসায়ীরা ওটাও খেয়ে নেয়।
গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তেলের দাম ২০ টাকা বেড়ে হয় ১৪০ টাকা, তারপর মে মাসে আবার লিটারপ্রতি বাড়ে ১২ টাকা, অক্টোবরে বাড়ে ৭ টাকা আর সবশেষ চলতি বছর ফেব্রুয়ারিতে ১০ টাকা বেড়ে লিটারপ্রতি দাম নির্ধারণ করে ১৭০ টাকা। দেশে প্রতি বছর ২২ থেকে ২৫ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে। এর প্রায় সবটাই আমদানি করতে হয়। তবে গেল এক বছরে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৪ বার।