উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে প্রযুক্তির সহজলভ্য ও পর্যাপ্ত হস্তান্তর নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের (ফোরআইআর) সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হবে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা।
একই সঙ্গে তার সরকার চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিভিন্ন সময়োপযোগী নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে বলেও জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।
শনিবার (১১ ডিসেম্বর) গণভবন থেকে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ১০ ডিসেম্বর থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে চতুর্থ শিল্পবিপ্লববিষয়ক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমরা জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সৃষ্টি করেছি। এক্ষেত্রে তিনি তার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে কৃতিত্ব দেন।”
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক টেকসই শিল্পোন্নয়নে (আইএসআইডি) কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমরা ‘এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর এখন ‘উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’র দিকে এগোচ্ছি। ২০৪১ সালের মধ্যে যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখছি, সেটাই হবে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ।”
এ সময় বাংলাদেশ সরকারের কাছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ভিত্তি হিসেবে তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্ব পাচ্ছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, “এরমধ্যে রয়েছে- অত্যাধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে শিল্পের বিকাশ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কর্মী বাহিনী সৃষ্টি ও পরিবেশ সংরক্ষণ। জাতির পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র নয় মাসেই একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছেন এবং এই তিনটি বিষয়কে রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছেন- ১৬-অনুচ্ছেদে ‘জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূরীকরণে গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতায়ন, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ’, ১৭(খ)-অনুচ্ছেদে ‘সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নাগরিক সৃষ্টি’ এবং ১৮(ক) অনুচ্ছেদে ‘বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ’।”
সরকার প্রধান বলেন, “যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনকালেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত চালু করেন। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞান ও গবেষণাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ‘কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’ গঠন করেন।”
এ সময় ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক অধ্যায় স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “দুর্ভাগ্য, জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। সংক্ষিপ্ত সময়েই তিনি শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প খাতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করেছিলেন। ১৯৭৪-১৯৭৫ অর্থবছরে ৯ শতাংশের উপরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল। যা ধরে রাখতে পারলে পরবর্তী ১০ বছরেই বাংলাদেশ হয়ে উঠত তার স্বপ্নের ‘সোনার বাংলাদেশ’।”
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমি অত্যন্ত আনন্দিত, এ সম্মেলনে দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পোদ্যোক্তাসহ অনেকেই অংশগ্রহণ করেছেন। তিনজন নোবেল বিজয়ী এবং ছয়জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। দুটি সাইড ইভেন্ট ‘মুজিব-১০০ আইডিয়া কনটেস্ট’ এবং ‘মুজিব-১০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিট’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া ১৭টি দেশ থেকে মোট ৫২৫টি গবেষণাপত্র জমা হয়েছে এবং তার মধ্য থেকে ১০০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে। সহস্রাধিক আইডিয়া থেকে ১০টিকে সেরা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, যারা প্রত্যেকে ১০ লাখ টাকা পুরস্কার পাবেন। আমি সব অংশগ্রহণকারীকে অভিনন্দন জানাই।”
শেখ হাসিনা আরও বলেন, “আমি মনে করি ‘চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন’ একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। আমি আশা করি, এই সম্মেলনে অর্জিত জ্ঞান আমাদের শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি নিবিড় বন্ধন সৃষ্টি করবে। ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সম্পর্কিত গবেষণা এবং উদ্ভাবনকে বাস্তবে রূপদান করা সহজতর হবে।”
এ সময় প্রধানমন্ত্রী ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং দুই লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোন এবং পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সব শহীদকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন।
প্রায় ১০০ বছর পরপর শিল্পায়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় অতিক্রম করে আমরা আজ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। এ পর্যায়ে সাশ্রয়ী এবং সবুজ ভ্যালু-চেইন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পৃথিবী আজ দু’ভাগে বিভক্ত। একদিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী ও সহজে ব্যবহারকারী সম্পদশালী দেশগুলো এবং অন্যদিকে এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগে অক্ষম রাষ্ট্রপুঞ্জ।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে। কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন- মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে, সস্তা শ্রমের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বাড়বে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে এবং প্রযুক্তিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে।”
এছাড়া অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত অর্থনীতিবিদ যোসেফ সুম্পিটারের ‘ক্রিয়েটিভ ডেস্ট্রাক্শন’ তত্ত্ব অনুযায়ী নিত্যনতুন উদ্ভাবনের ফলে প্রচলিত কর্মক্ষেত্র সংকুচিত হবে ঠিকই, কিন্তু নতুন ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগও সৃষ্টি হবে- বলেন তিনি।
দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনশক্তিতে রূপান্তর করতে তার সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এ.আই), রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অফ থিংস সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হবো।”
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “দেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১২ কোটি ছাড়িয়েছে। শিগগিরই আমরা ৫-জি নেটওয়ার্ক সেবা চালু করছি। এটি ব্যবসার মডেল, শিক্ষা-পদ্ধতি, জীবনযাত্রার মান, প্রচলিত ডিজিটাল ও সোশ্যাল মিডিয়াকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দেবে।”
ডাকঘরগুলোকে ডিজিটাল সেন্টারে রূপান্তরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারগুলোকে ফাইবার অপটিক্যাল তারে যুক্ত করা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন, হাজার হাজার ইন্টারেক্টিভ কন্টেন্ট এবং ই-বুক ডিজাইন করা হয়েছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পপণ্যগুলোকে ই-কমার্স প্লাটফর্মে যুক্ত, অটোমেশন, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট এবং ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান উন্নতি করা হচ্ছে।”
অদূর ভবিষ্যতে আইসিটি ও সফটওয়্যার শিল্প দেশের রপ্তানি খাতকে নেতৃত্ব দেবে বলেও দৃঢ় আস্থা প্রকাশ করেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনা বলেন, “আমরা আন্তর্জাতিক শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বাংলাদেশে গবেষণা উন্নয়ন এবং উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে বিশেষ সুবিধা দিচ্ছি। নোকিয়া, স্যামসাং, হুয়াওয়েসহ অনেক কোম্পানি হাই-টেক পার্কগুলোতে কাজ করছে। উৎপাদন খাতে আমরা ‘বৃত্তীয় অর্থনৈতিক মডেল’ গ্রহণ করছি। যার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিরাপদ, পুনর্ব্যবহারযোগ্য ও দীর্ঘস্থায়ী পণ্য উৎপাদন শুরু করেছি।”
সরকারপ্রধান বলেন, “এরই মধ্যেই আমরা চাহিদার চেয়ে অধিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা অর্জন করেছি। রপ্তানি ক্ষেত্রে ১১টি সম্ভাবনাময় খাত চিহ্নিত করেছি। একশো অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে অতিরিক্ত এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান করছি। এছাড়া মার্কিন গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি) এর তথ্য আনুযায়ী, আমাদের ১৪৪টি কারখানা ‘লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট ডিজাইন (এলইইডি)’ সনদ পেয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে ৪১টি প্লাটিনাম, ৮৯টি গোল্ড, ১২টি সিলভার এবং ৩টি সাধারণ সনদ পেয়েছে। আমরা গর্বিত, বিশ্বের ১০০টি সেরা কারখানার মধ্যে ৩৯টি বাংলাদেশের। আমরা হাইব্রিড গাড়ি আমদানিতে শুল্ক সুবিধা দিচ্ছি এবং বৈদ্যুতিক গাড়ি চালুর কাজ শুরু করেছি।”
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, “আমরা প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি কলেজ স্থাপন করছি। বেশ কয়েকটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছি। আমরা গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য বাজেট বাড়ানোর মাধ্যমে একটি উদ্ভাবনী শিক্ষা ইকোসিস্টেম তৈরি করছি। ন্যাশনাল ব্লেন্ডেড লার্নিং পলিসি-২০২১ প্রণয়ন করছি। এ নীতির মাধ্যমে আমরা প্রযুক্তি বিভেদমুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে পারব।”