• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

দুর্ঘটনার পরও নেই কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২২, ০৪:৩৫ পিএম
দুর্ঘটনার পরও নেই কোনো নিরাপত্তাবেষ্টনী

ঢাকা-গাজীপুর সড়কে ঝুঁকি নিয়েই বাস র‍্যাপিড ট্রানজিটের (বিআরটি) উড়ালসড়কের গার্ডার ওঠানোর কাজ চলছে। সম্প্রতি গার্ডারের চাপায় প্রাইভেট কারের পাঁচ আরোহী নিহত হন। এরপরও উত্তরায় বিআরটির নির্মাণাধীন এলাকায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বুধবার (১৭ আগস্ট) বিমানবন্দর থেকে রাজলক্ষ্মী পর্যন্ত প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, উড়ালসড়কের গার্ডার স্থাপনের কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। সড়কের মাঝখানে একটার ওপরে আরেকটা স্তূপ করে গার্ডার রাখা আছে।

দুর্ঘটনাস্থলের পাশে ক্রেন ও গার্ডার পড়ে আছে। প্রকল্প ঘিরে কোনো রকম নিরাপত্তাবেষ্টনী নেই। বিভিন্ন জায়গায় নির্মাণসামগ্রী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা হয়েছে। কংক্রিটের স্ল্যাব থেকে লোহার রড বেরিয়ে আছে। সড়কে বালুর স্তূপ ঢেকে রাখা হয়নি। এতে বাতাসে বালু উড়ছে।

অন্যদিকে, বৃষ্টি হওয়ার কারণে বিআরটি প্রকল্পের উড়াল সড়কের নিচে একটু পরপর পানিতে পরিপূর্ণ ছোট ছোট গর্ত দেখা গেছে। যার মধ্যে প্রচুর ময়লা-আবর্জনা জমে পরিবেশে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন জানান, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে কীভাবে এমন প্রকল্পের কাজ শুরু হলো। আসলে কর্তৃপক্ষের কাছে জনগণের প্রাণের কোনো মূল্য নেই।

সড়কে যানবাহন চলাচলে ঝুঁকি

প্রকল্পের অংশ হিসেবে বিমানবন্দরের সামনের সড়কের মাঝবরাবর খুঁড়ে রাখা হয়েছে। কোনো ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী না থাকায় পাশ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চলছে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে পড়তে হচ্ছে।

যা বলেছেন ডিএনসিসি মেয়র

মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বলেন, “খামখেয়ালির কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে। কাজের কমপ্লায়েন্স (নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অন্যান্য নিয়ম) মানা হলে এ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এখানে কাজের শর্তাবলির কোনো কিছু মানা হয়নি। কোনো নিরাপত্তা নেই। ওপরে ঝালাইয়ের কাজ করছে। আগুনের স্ফুলিঙ্গ নিচে ছিটকে পড়ছে। এখানে কোনো সাইনবোর্ড পর্যন্ত লেখা নেই যে এখানে বা এদিকে কাজ চলছে।”

মেয়র আতিক বলেন, “সড়কের ওপর নির্মাণকাজ চলার সময় যানবাহন ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রকল্পের কাজের অংশ। এ জন্য নির্মাণ এলাকা ঘিরে রাখার নিয়ম। কিন্তু প্রায় এক দশক ধরে চলা বিআরটি প্রকল্পে এর কিছুই মানা হয়নি।”

যিনি ক্রেন চালাচ্ছিলেন, তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা রয়েছে কি না, ক্রেন ত্রুটিমুক্ত ছিল কি না, ক্রেন ক্রাশ করলে পেছনে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য অন্য ক্রেন প্রস্তুত ছিল কি না, অ্যাম্বুলেন্স থাকার কথা ছিল কি না—এসব প্রশ্ন তোলেন মেয়র।

যা বলছে ডিবি

বুধবার (১৭ আগস্ট) ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, “গার্ডারের চাপায় পাঁচজন নিহতের ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। ওই মামলাটি থানা পুলিশ তদন্ত করছে। আমরাও ছায়া তদন্ত করছি। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।”

আরও পড়ুন… ‘গার্ডার চাপার ঘটনায় ছায়া তদন্ত করছে ডিবি’

হাইকোর্টে রিট

এদিকে দুর্ঘটনায় শিশুসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা করে মোট ৫ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়েছে। রিটে গত পাঁচ বছরে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিআরটি কী ধরনের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়েছে তার একটি প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে।

বুধবার সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জাকারিয়া খানের পক্ষে আইনজীবী শাহজাহান আকন্দ মাসুম এ রিট দায়ের করেন।

আরও পড়ুন… গার্ডার চাপায় নিহতদের প্রত্যেকের জন্য কোটি টাকা চেয়ে রিট

এর আগে মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) এই ঘটনায় আরেকটি রিট দায়ের করা হয়। ওই রিটে ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও জনগণের চলাফেরায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাগুফতা আহমেদ এ রিট দায়ের করেন।

স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে।

নিহত ৫ জনের দাফন সম্পন্ন

মঙ্গলবার বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশগুলো হস্তান্তর করা হয়।

নিহত রুবেলের লাশ গ্রহণ করেন তার ছেলে হৃদয়। তিনি জানান, লাশটি প্রথমে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে জানাজা শেষে তার লাশ কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে নিয়ে আমার দাদা-দাদির পাশো দাফন করা হবে।

নিহত ঝর্ণা আক্তারের লাশ গ্রহণ করেন তার ভাই মনির হোসেন। এ সময় তার আরেক বোন ও এক ভাগ্নে এবং এক ভাগ্নির লাশ গ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন… গার্ডার পড়ে নিহত রুবেলের দাফন সম্পন্ন

এরপর নিহত পাঁচজনের মধ্যে চারজনের জানাজা ও দাফন জামালপুরে সম্পন্ন হয়েছে। দাফনকৃতরা হলেন- ঝরনা, তার দুই শিশুসন্তান জান্নাত ও জাকারিয়া এবং বড় বোন ফাহিমা।

নিহত রুবেল মিয়ার দাফন বুধবার সম্পন্ন হয়েছে। মেহেরপুর জেলার সদর উপজেলার রাজনগর গ্রামে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়।  

যা বলছে উত্তরা পশ্চিম থানা

উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোহসীন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঘটনার দিন মধ্যরাতে মামলা হয়েছে। মামলার আসামি করা হয়েছে ক্রেন পরিচালনাকারী চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তার দায়িত্বপ্রাপ্তদের। চায়না কোম্পানির সঙ্গে চুক্তির নথি ঘেটে দেখা হবে যে কী কী বিষয়ে তারা গাফিলতি করেছে।”

তিনি আরও বলেন, “আসামি গ্রেপ্তারের চেষ্টা ও পুলিশের তদন্ত চলছে। বিআরটি কে প্রকল্পের নথি চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।”

যা ঘটেছিল 
সোমবার (১৫ আগস্ট) বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে উত্তরার জসীম উদ্দীন রোডের মোড়ে বিপণিবিতান আড়ংয়ের সামনে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের কংক্রিটের বিশাল গার্ডার ক্রেন দিয়ে তোলার সময় চলন্ত একটি গাড়ির ওপর ছিটকে পড়ে। গার্ডারটি গাড়ির ওপর এমনভাবে পড়ে যে তার নিচে আসলে কয়জন চাপা পড়েছেন সেটা কোনোভাবেই বোঝা যাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, গাড়িটিতে মোট ৭ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে পাঁচজন নিহত হন। বেঁচে যাওয়া দুজন হলেন নবদম্পতি হৃদয় (২৬) ও রিয়া মনি (২১)। হৃদয়-রিয়া মনির বউভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে ফিরছিলেন সবাই।

এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় নিহত ঝরনা আক্তারের ভাই মো. আফরান মণ্ডল বাদী হয়ে মামলা করেন।

Link copied!