রাজধানীর বেগুনবাড়ি বস্তি এলাকায় এক কক্ষের একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন হাজেরা বেগমসহ তার দুই সন্তান। মানুষের বাসায় কাজ করে চলে তার সংসার। কোরবানির ঈদ ছাড়া মাংস খাওয়ার সুযোগ পান না তিনি।
হাজেরা বেগম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “মানুষের বাসায় কাজ করে যে টাকা আয় করি, তার তা দিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে বাকি টাকা কোনোমতে ডাল-ভাত খেয়ে দিন পার করতে হয়। অভাবের সংসারে আবার গরুর মাংস খাব কী করে। শেষ মাংস খেয়েছি কোরবানির ঈদে, আবার খাব ঈদে।”
সরকারের এক তথ্য দেখা যায়, দেশে প্রতিবছরই বাড়ছে গরু-মহিষ ও ছাগল-ভেড়ার উৎপাদন। ২০২০-২১ অর্থবছরেও প্রায় চার লাখ পশু উৎপাদন বেড়েছে। এর মধ্যে ১ লাখ ৫৪ হাজারই গরু। চাহিদার তুলনায় মাংস উদ্বৃত্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন। তার পরও গরুর মাংসের দাম বাড়ছে। মাংস কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস ভোক্তাদের। খামারিরা বলছেন, গোখাদ্য, জায়গা ও পরিবহন ভাড়া, খাজনা ইত্যাদি বাড়ায় তারা গরুর দাম পাচ্ছেন না।
অন্যদিকে রাজধানীর বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, বর্তমানে গরুর মাংস ৬৫০ টাকা কেজি পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মানভেদে কোথাও কোথাও তা আবার ৭০০ টাকা কেজি। খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৯০০ থেকে ৯৫০ টাকা কেজি দরে।
গত কয়েক মাসে এমনিতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। এমন অবস্থায় রাজধানীতে বসবাস করা মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা কীভাবে মাংস খেয়ে মিটাবে আমিষ চাহিদা। রাত পোহালেই ব্যয় বাড়ে। চাল-পেঁয়াজের বাজারে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। সব মিলিয়ে আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের টালি মেলাতে পারছেন না অনেক মানুষ। এতে সাধারণ মানুষের অনেক ব্যয় কমাতে হচ্ছে। কমাতে হচ্ছে অতি প্রয়োজনীয় চাহিদাও।
রামপুরা মহানগর এলাকায় দুই সন্তান নিয়ে থাকেন মাহফুজুর রহমান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। দুই সন্তানের স্কুলের খচর, মাসের বাজার এবং নিজের মতিঝিলের অফিসে যাতায়াতের খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম অবস্থা। এই চাকরিজীবী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এখন যেভাবে চলছি এটা জীবন না। কোরবানির ঈদ ছাড়া কখনো বাচ্চাদের খাওয়াতে পারি না গরুর মাংস।”
কারওয়ান বাজারের মাংস ব্যবসায়ী কাজী আনোয়ার সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “মাস কয়েক আগে যে গরু ৯৩ থেকে ৯৫ হাজার টাকায় কেনা যেত, তা এক লাখ টাকার কমে মিলছে না। প্রতিটি গরুতেই পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা বাড়তি লাগছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগে চামড়া বিক্রি করা যেত পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। এখন এক হাজার টাকায়ও বিক্রি করতে কষ্ট হয়। দোকান ভাড়া, নিজেদের খরচ বেড়েছে। মাংস বেচে চলা মুশকিল। তাই বাড়তি দামে মাংস বিক্রি করতে হয় আমাদের।”
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবমতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে এই পশু উৎপাদন ছিল ৫ কোটি ৫৯ লাখ ২৬ হাজার। ২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন ৩ লাখ ৯৯ হাজার বেড়ে এই সংখ্যা হয় ৫ কোটি ৬৩ লাখ ২৮ হাজার। এর মধ্যে ৪৪ শতাংশ গরু, ৪৫ শতাংশ ছাগল। বাকিগুলো মহিষ ও ভেড়া। গত অর্থবছর গরুর মোট উৎপাদন ছিল ২ কোটি ৪৫ লাখ। আগের বছর ছিল ২ কোটি ৪৩ লাখ ৯১ হাজার। অর্থাৎ গরুর উৎপাদন বেড়েছে ১ লাখ ৫৪ হাজার।
অধিদপ্তরের হিসেবে আরও দেখা যায়, দেশে জনপ্রতি মাংসের চাহিদা রয়েছে দৈনিক ১২০ গ্রাম। সে হিসাবে বছরে মাংসের চাহিদা ৭৪ লাখ ৩৭ হাজার মেট্রিক টন। দেশে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৮৪ লাখ ৪০ হাজার টন। অর্থাৎ মাংসের উদ্বৃত্ত ১০ লাখ টন। আগের বছর উদ্বৃত্ত ছিল প্রায় আড়াই লাখ মেট্রিক টন।
অন্যদিকে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে, ২০২১ সাল শেষে গরুর মাংসের দাম বেড়ে কেজিপ্রতি ৬৫০ টাকা হয়েছে। ২০২০ সাল শেষে গড়ে যা ছিল ৫৮৮ টাকা। ২০১৯ সালে ৫৪০, ২০১৮ সালে ৫২৭ টাকা কেজি ছিল।
তারা আরও জানায়, দেশে মাংসের বাজারে বড় পরিবর্তন আসে ২০১৭ সালে। আগের বছরের তুলনায় এক লাফে কেজিপ্রতি ১০০ টাকা বেড়ে ৫২০ টাকায় ওঠে ওই বছর। ২০১৬ সালে গড়ে ৪২০ টাকা কেজিতে গরুর মাংস পাওয়া যেত।
আপনার মতামত লিখুন :