• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

হয় নাই ফেরা : পাঠ প্রতিক্রিয়া


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২২, ১১:৪৯ এএম
হয় নাই ফেরা : পাঠ প্রতিক্রিয়া

হয় নাই ফেরা। প্রিয়রঞ্জন পাল। প্রায় চারশত পৃষ্ঠার এই বইটির শিরোনামেই আছে বিষণ্ণতার আভাস, সমাপ্তিতে সেটি যেন চারপাশ থেকে আরও শক্তভাবে ঘিরে ধরে।

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ যে প্রক্রিয়ায় স্বাধীনতাপ্রাপ্ত হয়, তা এ অঞ্চলের হিন্দু মুসলিম উভয়ের জন্যই রেখে যায় এক অনিরামেয় ক্ষতচিহ্ন। কেননা, বহু আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার জন্যে সমগ্র ভারতবাসীকে অপরিমেয় ত্যাগ স্বীকার করতে হলেও এর অনুষঙ্গ রূপে অতি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে যুক্ত হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা, দেশভাগ। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত মুক্ত ভূমিতেও দেশ ও আত্মপরিচয় নিয়ে মানুষের নানা মাত্রিক সঙ্কট, দেশের সন্ধানে চিরকালের দেশ ও পরিজন ছেড়ে পথে পথে বাস্তুত্যাগী মানুষের ঢল ইত্যাদি বেদনাদায়ক ঘটনা।

দেশভাগজনিত এই ট্র্যাজেডি এবং প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলীকে উপজীব্য করেই গড়ে উঠেছে ‘হয় নাই ফেরা’ উপন্যাসের আখ্যানভাগ। এই বিষয়বস্তুকে নিয়ে বাংলা কথাসাহিত্যে ইতোপূর্বে কালজয়ী বেশ কিছু গল্প উপন্যাস বা কবিতা যেমন লেখা হয়েছে, তেমনি নাটক, চলচ্চিত্র  এবং সঙ্গীতেও এর শিল্পোত্তীর্ণ নানা প্রকাশ ঘটেছে। বর্ণনায় না গিয়ে এ বিষয়ে হেমাঙ্গ বিশ্বাসের বহুশ্রুত ‘সুরমা নদীর গাঙচিল’ গানটির কথা স্মরণ করা যেতে পারে—

হবিগঞ্জের জালালি কইতর /সুনামগঞ্জের কুড়া 
সুরমা নদীর গাঙচিল আমি/ শূন্যে দিলাম উড়া 
শূন্যে দিলাম উড়ারে ভাই/ যাইতে চান্দের চর 
ডানা ভাইঙ্গা পড়লাম আমি/ কইলকাত্তার উপর
তোমরা আমায় চিননি...

তবে দেশভাগের মত বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া মানুষের অবর্ণনীয় টানাপোড়নের আবহে ‘হয় নাই ফেরা’ উপন্যাসের ঘটনা বিন্যাস শুরু হলেও লক্ষণীয় যে, পরবর্তীতে তা প্রধানত পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি ও নানা রাজনৈতিক পট পরিবর্তন, জন্মভূমির মায়া ত্যাগ করতে না পারা মানুষের ভিটেমাটি আঁকড়ে টিকে থাকার লড়াই, পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান, পাক জান্তার শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতির অপ্রতিরোধ্য ঐক্য, সর্বোপরি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের মত ঘটনাবলীর দিকেই নিবদ্ধ থেকেছে।

বাংলাদেশের অন্য দশটি গ্রামের মতই বগুড়া শহরের সন্নিহিত কৃষিকেন্দ্রিক জনপদ পালসা। এই পালসায় পুরুষানুক্রমে বসবাস করে আসা কুন্ডু পরিবারের নানামুখী সঙ্কট ও টানাপোড়নকেই ‘হয় নাই ফেরা’ উপন্যাসে সামনে নিয়ে আসার প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।

আবহমান বাংলার সম্প্রীতিময় জীবনের অংশ হয়েও সাতচল্লিশের দেশভাগ তথা পার্টিশনের মত ঘটনা, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, চেনা মানুষজনও অচেনা হয়ে ওঠা ইত্যাদি ঘটনার জেরে সর্বগ্রাসী আতঙ্ক ও আত্মপরিচয় সঙ্কটে নিপতিত অসংখ্য পরিবারের মত পালসার কুন্ডু পরিবারও এক কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। যেন আকস্মিক এক ঘূর্ণাবর্তে বিশেষ করে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের মনোজগতে ঘটে যায় বিরাট ওলট পালট।

পরিস্থিতির নানামুখী অভিঘাতে অস্থির এই সময়ে কুন্ডু ভাইদের অন্যতম সুবোধ কুন্ডু শেষ পর্যন্ত ভারত রাষ্ট্রকেই নিজের স্বদেশ রূপে বেছে নেন। সপরিবার পাড়ি জমান পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাটের তপন এলাকায়। পালসার উর্বর আবাদি জমি নয়, মাটি এখানে প্রায় সুখা এবং রুক্ষ। খাদ্যপণ্যের সঙ্কট এখানে সর্বব্যাপী। এমন বিরুদ্ধ পরিবেশেই শুরু হয় সুবোধ কুন্ডুর নতুনতর জীবন সংগ্রাম। আর নামের সাথে বলতে গেলে স্থায়ী একটা বিশেষণ যুক্ত হয়ে যায়, সেটি  হল রিফিউজি।

কুন্ডু পরিবারের অন্যান্য সদস্য নানা অনিশ্চয়তার মাঝেও নিজ বাসভূমে থেকে গেলেও অস্বস্তি তাড়া করে ফেরে প্রতি মুহূর্তেই। কেননা দেশটার নাম এখন পাকিস্তান। পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গে এখন বিস্তর ব্যবধান। পাসপোর্ট-ভিসা তো আছেই, আরও আছে দুই দেশের নিজস্ব আইন কানুনও। দার্জিলিং মেইলে করে শান্তাহার জংশন হয়ে কলকাতার যাত্রী হওয়া, সবই এখন আইনের বেড়াজালে আটকা। তবুও ওপাড় বাংলায় রিফিউজি তকমা পাওয়া দাদার সঙ্গে এপারে থেকে যাওয়া ভাইদের মধ্যে যোগাযোগটা একেবারে ছিন্ন হয়নি। দুপক্ষ থেকেই যতটা সম্ভব খবরাখবর রাখার চেষ্টাটা কোনোরকমে চালু থাকে। তবে যখন দেখাসাক্ষাৎ হয়, আনন্দের চেয়ে আক্ষেপের সুরটাই বড় হয়ে বাজে। এ জন্যই দীর্ঘদিন পর দাদা সুবোধ কুন্ডুর বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সুবাদে বৌদি সুপ্রভা যখন বিনোদ কুন্ডুকে দুপুরের খাবার খেতে বসার তাড়া দেন, তখন বিনোদ কুন্ডু আনমনেই অতীতে ফিরে যান। সেই একই কথা, একই ডাক—আয়া পড় সবাই, খাওয়া দেয়ন হইছে। তার কেবলই মনে হয়, ‘একই মানুষ, একই ডাক, শুধু ডাক দেয়নের জায়গা আলাদা, বৌদি এখন ডাক দেয় ভিন্ন দেশে।” দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে বিনোদ কুন্ডুর মনে ঘুরপাক খেতে থাকে সেই অনিবার্য প্রশ্ন—কেন দ্যাশ আলাদা হয়, মানুষ আলাদা হয়।

পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির হাল চাল নিয়ে ওদিকে সুবোধ কুন্ডুর যেমন উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, এ পাড়ের প্রমোদ কুন্ডু বা বিনোদ কুন্ডুর ক্ষেত্রেও বিষয়টি ঠিক সেরকমই। বিশেষ করে যখন খবর আসে এ পাড়ে উর্বরা আবাদি জমির সুবাদে ধান চাল নিয়ে তেমন চিন্তা না থাকলেও ওপাড়ের চিত্র ভিন্ন। খাদ্য সঙ্কট সেখানে প্রকট। এমন কি এক জেলার খাদ্যপণ্য অন্য জেলায় পরিবহনেও নানা বিধিনিষেধ, তখন এ পাড়ের কুন্ডুরা বিস্মিত না হয়ে পারে না। তারা আরও বিস্মিত হন এই কথা শুনে যে, সমাজ বদলানোর লড়াই ওপাড়েও নতুন উদ্যমে চালু হয়েছে, সেখানে নাম লিখিয়েছে সুবোধ কুন্ডুর কলেজ পড়ুয়া ছেলে স্বপনও। পুলিশের তাড়া এবং ধরপাকড় এড়াতে অনেক সময় বন্ধুদের সঙ্গে তাকেও লুকিয়ে চলতে হয়, অথবা আত্মগোপনে যেতে হয়।

কিন্তু নিজ বাসভুমে যারা থেকে গেল, তাদের জীবনচিত্রও কি বদলে যাচ্ছে? পালসার হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য এটাও এখন বিরাট এক প্রশ্ন। বিশেষ করে পাকিস্তানপন্থী কেয়ামত শেখের মত কিছু মানুষের পাশাপাশি বিহারি জনগোষ্ঠীর নানা উস্কানিমূলক কার্যকলাপের নানা খবর হিন্দু সম্প্রদায়ের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা বাড়িয়েই চলে। এমনকি বাচ্চাদের খেলাধুলায় যেখানে কোনোকালে বড়রা নাক গলায়নি, তুচ্ছ কারণে সেসব বিষয়েও হিন্দু-মুসলমান বিভাজন ও বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। তারই জলজ্যান্ত উদাহরণ কেয়ামত শেখের শাসানি, “আগে কী হইচে হয় নাই ওই সব ছাড়ান দেন। এখুন আইয়ুব খানের শাসনে কোনো হিন্দু পোলা মুসলমানের পোলারে মারলে তার ফল ভাল হব না।”

তবে এতসব অস্বস্তির মাঝেও স্বস্তির জায়গাও আছে। কারণ এই সমাজে এখনো খালেক মিয়ার মত মানুষেরা আছেন। সকল জাত বিভাজনের ওপরে যাদের কাছে প্রতিবেশী পরিচয়টাই বড়, মানুষের বিপদ আপদে যারা নিজের বিপদ তুচ্ছ জ্ঞান করেন, পাশে এসে দাঁড়াতে কুণ্ঠিত হন না।

কুন্ডু পরিবারের নানামুখী সঙ্কট ও টানাপোড়নকে কেন্দ্রে রেখে এই উপন্যাসের লেখক মূলত পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক চালচিত্রের প্রধান প্রবণতাগুলোকে সামনে নিয়ে আসতে সচেষ্ট হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই শাসকচক্র দেশটির পশ্চিম অংশকে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে পরিণত করে কিভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী, স্বেচ্ছাচারী ও পক্ষপাতমূলক রাষ্ট্রের উদাহরণ সৃষ্টি করে যাচ্ছিলেন, তার চালচিত্র উপন্যাসটিতে গুরুত্ব সহকারেই স্থান পেয়েছে। সীমাহীন বঞ্চনা ও বৈষম্যের পাশাপাশি ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, চিরকালীন জীবনাচার, এমনকি প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চার মত বিষয়েও শাসকগণ হিন্দুয়ানী তথা ভারতীয় সংযোগ আবিষ্কারের কূটকৌশল অনুসরণ করায় বাঙালি জনগণের যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, তারই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ইতিহাসের বিশাল ক্যানভাসজুড়ে বাঙালি জাতির যে সংগ্রামী অভিযাত্রা, তার নানা ঘাত প্রতিঘাতের সঙ্গে পদ্মা, মেঘনা, যমুনাকে ঠিকানা মান্য করে চলা বিপুল মানুষের মতই পালসার কুন্ডু পরিবারের ভবিষ্যতও ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যায়।

১৯৭১ এর ঘটনাবহুল মুক্তিযুদ্ধ যেমন দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ, তেমনই সেই সময়ের এক একটি পরিবারের জীবনযুদ্ধও বটে। হাজার হাজার পরিবারের  আত্মত্যাগের অসংখ্য ইতিহাসের সমষ্টিই হয়তো মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। সেই গৌরবের অংশীদার কুন্ডু পরিবারও।

সাতচল্লিশে দেশত্যাগ না করলেও একাত্তরে এসে পাকবাহিনী অধিকৃত ভূখণ্ড থেকে পাড়াশুদ্ধ মানুষকে ঠিকই দেশান্তরে যেতে হয়। তবে বাড়িঘর আগলে থেকে যান বয়োজ্যেষ্ঠ বিনোদ কুন্ডু। কিন্তু কেয়ামত শেখের মত অতি উৎসাহী সহযোগীরা যেখানে আছে, সেখানে বিনোদ কুন্ডুর আর বেঁচে থাকার সুযোগ হয়নি। তবুও পরিবারটি জন্য স্বস্তি এটুকুই যে, পরিবারটির বাকি সদস্যরা এই পরিবারের কলেজ পড়ুয়া মেয়ে বুলবুলিসহ অন্যান্য নারীদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত সীমান্তের ওপাড়ে পা রাখতে সক্ষম হয়। তবে এই সামান্য স্বস্তিও এক সময় গভীর বেদনায় পর্যবসিত হয়, যখন জানা যায়, দেশের জন্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বুলবুলির বাগদত্তা নীলফামারীর তরুণ ছাত্রনেতা মৃগাঙ্ক একটি অপারেশনে পাকবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে তলিয়ে গেছেন অতল ঘুমের তলে।

শিল্পগত উৎকর্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যেক উপন্যাসেরই কিছু সমালোচনার জায়গা থাকে। ‘হয় নাই ফেরা’ নিয়েও হয়তো সেরকম বিচার বিশ্লেষণের অবকাশ আছে। তবে সার্বিক বিচারে বলা যায়, যে লক্ষ্য নিয়ে এই উপন্যাসের যাত্রারম্ভ এবং ইতিহাসের একটি বিশেষ কালপর্বব্যাপী সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনাবলীর জেরে মানুষের মনোজগতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তার যে নানা মাত্রিক অভিঘাত, এইসব  বিষয় উপস্থাপনে ঔপন্যাসিক প্রিয়রঞ্জন পাল তার দিক থেকে শেষাবধি নির্মোহ ও আন্তরিক থেকেছেন।

উপন্যাসটির সমালোচনা প্রসঙ্গে খুব গভীরে না গিয়েও সাধারণ একজন পাঠকের পাঠ প্রতিক্রিয়ার জায়গা থেকে  দু-একটি বিষয় আলোচনায় আনা যেতে পারে।

ভাষা শৈলী

যে কোনো উপন্যাসে এর চরিত্রসমূহ এতে প্রাণপ্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা পালন করে থাকে। সে দিক থেকে উপন্যাসে ভাষাশৈলীর যথাযথ প্রয়োগ  বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘হয় নাই ফেরা’ উপন্যাসের অধিকাংশ ঘটনা সংঘটনের স্থান ও চরিত্র পৌরাণিক ঐতিহ্যমণ্ডিত করতোয়া বিধৌত উত্তরের জেলা বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ এবং সেখানকার মানুষজন। উপন্যাসের ঘটনাসূত্রে পালসা, কাহালু, সারিয়াকান্দি, আদমদিঘী, মহাস্থানগড়, শেরপুর, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, সান্তাহার এসব অঞ্চলে বিচরণের যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাতে এর লেখক যে ভীনদেশী, সে বিষয়টি আমরা এক প্রকার ভুলেই যাই। তবে উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্রের কথোপকথনের ভাষা শুনে আমাদের সম্বিত ফিরে আসে। মনে হতে থাকে, বর্ণিত জনপদ সমূহের দৈনন্দিনের ভাষার সাবলীল ব্যবহার ও ভাষাভঙ্গি প্রয়োগে উপন্যাসের চরিত্রগুলো যেন কিছুটা হলেও আড়ষ্ট। যা উপন্যাসের চরিত্রগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশে এক ধরণের বাধা হয়ে উঠেছে। এটি না হলে উপন্যাসটি আরও গতিময় ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে পারত, এমনটাই মনে হয়।

ইতিহাস প্রসঙ্গ

‘হয় নাই ফেরা’ ঐতিহাসিক ক্যাটাগরির গ্রন্থভূক্ত কি না, সে প্রশ্নে না গিয়েও এর ঘটনাপ্রবাহ যে ইতিহাসের ছায়াকে ঘিরেই, সে বিষয়ে আমরা আগেই অবগত হয়েছি। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়েই এখানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গে সাতচল্লিশ থেকে একাত্তরব্যাপী ঐতিহাসিক কালপর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলী নানাভাবে ছুঁয়ে যায়। এক্ষেত্রে পঞ্জিকার নিরিখে ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ তথ্য উপাত্ত পরিবেশনের দায় হয়তো লেখকের ওপর বর্তায় না, কিন্তু পাঠকের দিক থেকে সেই চাহিদা থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। তথ্যগত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, এই উপন্যাসে এরকম ছোট ছোট কিছু বিষয় নজরে আসে। এসব বিষয় বিশেষ করে বাংলাদেশের পাঠকগণের নজর এড়িয়ে না যাওয়াই স্বাভাবিক। এমন কিছু বিষয়—

জুম্মাবারে সাপ্তাহিক ছুটির বিষয়টি পাকিস্তান আমলের ঘটনা নয়, বরং স্বাধীন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর সহানুভূতি পেতে এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

পাকিস্তান সরকার রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করলে এর প্রতিবাদে এ দেশের সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ প্রত্যক্ষ পরোক্ষ নানা আন্দোলনে শামিল হন। এই দলে ছিলেন কবি শামসুর রাহমানও। সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিবৃতিদাতাদের অন্যতম হিসেবে কবি শামসুর রাহমানের নামটি বর্তমান উপন্যাসে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। ষাটের দশকের সেই সময়টায় শামসুর রাহমানের মোটামুটি কবি পরিচিতি বা খ্যাতি ছিল বটে। তবে একথাও বিবেচনার রাখা প্রয়োজন যে, বিবৃতিদাতাগণের মধ্যে সাহিত্য জগতেরই কাজী মোতাহার হোসেন, কবি বেগম সুফিয়া কামাল, হাসান হাফিজুর রহমানসহ খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীনও ছিলেন।

১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেন, তা রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারের অনুমতি ছিল না। নির্দেশ ছিল, ‘নাথিং অব শেখ মুজিবুর রহমান উইল গো অন এয়ার, আনটিল ফারদার অর্ডার।’ পরবর্তী কালে গণদাবী এবং রেডিও স্টাফদের কর্মবিরতির মুখে বাধ্য হয়ে ভাষণটির অডিও রেকর্ড ৮ মার্চ সকাল ৮-৩০ মিনিটে প্রচার করা হয়।

গণ আন্দোলনে উত্তপ্ত দিনগুলোয় উপন্যাসের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র নীলফামারীর ছাত্র আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী, মেধাবী ছাত্র মৃগাঙ্ক গ্রেপ্তার এড়াতে চলে যান বগুড়ায় বোনের বাড়িতে। সঙ্গে সাত সাতটি কবিতার বই। তার মধ্যে বেশীর ভাগই নির্মলেন্দু গুণের। বিষয়টি উপন্যাসের দৃষ্টিকোণ থেকে অশুদ্ধ কিছু নয়। কিন্তু যারা জানেন যে, ১৯৭০ সালে প্রকাশিত ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ কাব্যগ্রন্থটিই  নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, তারা একটু ধন্দে পড়বেন বৈকি। কেননা যতদূর জানা যায়, তখন পর্যন্ত নির্মলেন্দু গুণের গ্রন্থসংখ্যা ওই একটিই।

উপন্যাসের নানা ঘটনাসূত্রে নজরে আসা উল্লেখিত বিষয়াবলী সরিয়ে রাখলে এ উপন্যাসের যে প্রশংসনীয় দিকটি উল্লেখ না করলে নয়, তা হল, এর লেখক নাগরিক হিসেবে ভারতীয় হলেও ভারতীয় সত্ত্বা নিয়ে নয়, বরং উপন্যাসের যাবতীয় ঘটনাবলীর সঙ্গে লেখকের যে মানসিক যোগ ও উপস্থিতি, সেখানে সব কিছু ছাপিয়ে তার বাঙালি সত্ত্বাকেই ওপরে দেখতে পাই। আবহমান বাংলা ও বাঙালির চিরায়ত লোকজীবনের প্রতি এক সহজাত অনুরাগ থেকে লেখক যেন নিজের জীবন ইতিহাসকেই খুঁজে ফিরেছেন, ব্রতী হয়েছেন নিজস্ব অন্তরাত্মার স্বরূপ সন্ধানে। উপন্যাসের ঘটনাবলীকে বস্তুনিষ্ঠ ও অন্তরঙ্গভাবে উপস্থাপনের দায়বদ্ধতা তার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণেই পরিদৃষ্ট। বিষয়বস্তুর সঙ্গে বিশ্বস্ততার সাথে যুক্ত থাকার তাগিদেই অবতারণা করেছেন সমসাময়িক নানা ঘটনা।

বইটিতে আবহমান বাঙলায় নানা আঙ্গিকের সাংস্কৃতিক চর্চা, গ্রামীণ মেলা, যাত্রাপালা ইত্যাদি প্রসঙ্গই শুধু নয়, বাঙালি মধ্যবিত্তের উত্থান ও নাগরিক সংস্কৃতি বিকাশের দিকটিতেও দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। উঠতি শিক্ষিতদের ফুটবল উন্মাদনা, থিয়েটার চর্চা, বগুড়া শহরের উত্তরা সিনেমা হলে চার্লি চ্যাপলিনের সিনেমা, মেরিনা হলে ফেরদৌসি রহমানের সঙ্গীত সন্ধ্যা, রওশন সার্কাসের জনপ্রিয়তা, সাতমাথা মোড়ের চা দোকানে তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের আড্ডা, শিক্ষা প্রসারে আজিজুল হক কলেজ, করোনেশন স্কুল, ভি এম গার্লস স্কুল কিংবা উডবার্ন লাইব্রেরির মত  প্রতিষ্ঠান সমূহের এগিয়ে চলা, এসব বিষয় তারই ইঙ্গিত বহন করে।

পূর্ব বঙ্গের মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সেখানকার ভাষা ও সংস্কৃতিও যে একই সূত্রে গাঁথা, তার দিগদিগন্তেও লেখক আলোকপাত করতে সচেষ্ট থেকেছেন। ফলে এখানে আইয়ুব বিরোধী নির্বাচনী জোট, বগুড়ায় নির্বাচনী প্রচারে ফাতিমা জিন্নাহর আগমন, ঢাকায় ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র মধুর ক্যন্টিন, হেমেন লাহিড়ী হত্যাকাণ্ড, তোতা মিয়ার শাহাদত বরণ ইত্যাদি বিষয় যেমন উল্লেখিত হয়েছে, তেমনি ভাষা সংগ্রামী গাজিউল হক, দানবীর রণদাপ্রসাদ, জননেতা মওলানা ভাসানী, কিংবদন্তী কমিউনিস্ট নেতা মণি সিংহ প্রমুখের নামও প্রসঙ্গত উল্লেখিত হয়েছে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতির অদম্য অভিযাত্রার মধ্যে লেখক যেন বাঙালি জাতিসত্তার নবজন্মের সুস্পষ্ট ছবিটিই প্রত্যক্ষ করেছেন।

এই আলোচনার সমাপ্তি পর্যায়ে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি ‘হয় নাই ফেরা’ উপন্যাসে সবার ওপরে মানব ভাবনাকেই যেমন প্রধানরূপে গণ্য করা হয়েছে, তেমনি বাংলার লোকসাধারণ কর্তৃক চর্চিত জীবনদর্শন ও সংস্কৃতি, অসাম্প্রদায়িক সমাজ চেতনা এবং প্রগতিমুখী ভবিষ্যত ভাবনারই বিজয় ঘোষিত হয়েছে।

লেখক : শফিকুল ইসলাম, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ।

Link copied!