• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

সাদেক বাচ্চু স্মরণে


আরাফাত শান্ত
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৪, ২০২২, ০৮:৫৫ পিএম
সাদেক বাচ্চু স্মরণে

সাদেক বাচ্চুকে নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। না ভেবে উপায় নেই, তিনি দুই বছর আগে এদিনে দুনিয়া থেকে চলে গেলেন। করোনাকালে আমরা আরেকজন বিখ্যাত অভিনয় শিল্পীকে হারিয়েছি। সাদেক বাচ্চুর কিছুদিন আগেই চলে গিয়েছিলেন আরেক গুণী টিভি অভিনেতা কে এস ফিরোজ। একটা জেনারেশন আস্তে আস্তে নিঃশেষ হয়ে গেল। করোনা এসে সেই গতির পালে হাওয়া দিয়েছিল। তখন প্রতিদিনই দেখতাম চেনাজানা গুণী লোকদের চলে যাওয়ার খবর। জানি না কবে শেষ হবে এই মিছিল।

সাদেক বাচ্চু নিয়ে এই প্রজন্মের মানুষের জানা উচিত। সেই ভাবনা থেকেই লিখতে বসা। সাদেক বাচ্চুকে আমরা হয়তো খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি আগে। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের জন্য অনেকদিন ধরেই গুরুত্বপূর্ণ এক অভিনেতা। কয়েক বছর আগে তাকে নিয়ে একটা ফিচার করা হয়েছিল পত্রিকায়, শত শিষ্যের এক গুরু। সেখানে দেখা গেল নব্বইয়ের পরে চলচ্চিত্রের সব নামকরা অভিনেতা আর অভিনেত্রী তার অবদানকে স্বীকার করে ভক্তির সাথে। প্রয়াত সালমান শাহ ডাকতেন তাকে বাবা বলে, প্রয়াত নায়ক মান্না তাকে বড় ভাইয়ের মত ভালোবাসতেন, সিনেমায় কীভাবে আরও বেটার করা যায় তা নিয়ে রাতের পর রাত আড্ডা দিতেন। অবশ্য তিনি এসব করতেন অভিনয়ের নেশা থেকেই। তার গুরু মোহাম্মদ আনিস বলেছিল, ‘কোনো অভিনয়কেই তুচ্ছ করে দেখবি না, যত ছোট রোলই হোক তাকে পূর্ণ করে তুলবি নিজগুণে, কাজ করে যাবি।’ তিনি তার থিয়েটার গুরুর এই মন্ত্র আজীবন লালন করেছেন অন্তরে। তাই তিনি ডাক বিভাগে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও অভিনয় করে গেছেন সবসময়। অভিনয় করার জন্য চাকরি ছাড়তেও প্রস্তুত ছিলেন।

কেউ তার জন্য সুপারিশ করেননি। তিনি টিভিতে কাজ পেয়েছেন এক মঞ্চ নাটকে একা অভিনয় করে। বিটিভির এক প্রযোজক তাকে সেখানে দেখে বিটিভিতে ডাকেন। সেখান থেকেই তার টেলিভিশন যাত্রা শুরু। অভিনেতা হিসেবে আরও আগে শুরু রেডিও থেকে। তারপর থিয়েটার, সঙ্গে পড়াশোনা তো চলছেই। ১৯৭২-৭৩ সময়ে তিনি ‘গণনাট্য পরিষদ’ নামের একটি থিয়েটারে যুক্ত হন। তিনি ‘উন্মোচন’ ও ‘প্রথম পদক্ষেপ’ নামের আরও দুটি থিয়েটার দলের হয়ে মঞ্চে অভিনয় করেন। দলগুলির মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ তার নিজের গঠিত দল। ১৯৮৪ সালে তিনি ‘মতিঝিল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার রচিত ও নির্দেশিত নাটকগুলির মধ্যে ‘কাফনের পকেট নাই’, ‘কুলাঙ্গার’  উল্লেখযোগ্য। ওনার যে গুরু তার হাত দিয়ে গড়ে উঠেছেন আমজাদ হোসেন, শওকত আকবর, হাসান ইমামদের মত মানুষ।

বিটিভিতে সাদেক বাচ্চুর শুরু, ‘নবহিল্লোল’ নামে তরুণ অভিনেতাদের এক অনুষ্ঠান দিয়ে। টেলিভিশনে তিনি ঝুমকা, পূর্ব রাত্রি পূর্বদিন, সোজন বাদিয়ার ঘাট, নকশী কাঁথার মাঠ, জোনাকী জ্বলে, গ্রন্থিক গণ কহে—এর মত জনপ্রিয় নাটকসহ এক হাজারের বেশী নাটকে অভিনয় করেছেন। টেলিভিশনে নাটকের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনেও অভিনয় করেছেন। আর সিনেমায় তার শুরু ‘রামের সুমতি’ দিয়ে। ‘রামের সুমতি’ সে আমলে হয়েছিল সুপার ডুপার হিট। রাস্তায় বের হলেই সাদেক বাচ্চুকে লোকজন ঘিরে ধরতেন। তার নাম সাদেক বাচ্চু হওয়ার কারণ অবশ্য বিটিভির সেই প্রযোজক। বললেন ‘মাহবুব আহমেদ সাদেক অনেক বড় নাম, তোমার নাম যেহেতু বাচ্চু তাই সাদেক বাচ্চু বানিয়ে দেই, চিনতে সুবিধা হবে, একটু অন্যরকম।’

গুরুর সেই দীক্ষা মেনে তিনি রোল পেলেই করতেন। নেগেটিভ রোল আসতো বেশি, মাঝেমধ্যে আসতো সাইড ক্যারেক্টার। সে সময়ের ব্যস্ত নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সঙ্গে একটা দৃশ্য অভিনয় করার সময়, ইলিয়াস পর্যন্ত অবাক হয়ে যান। বলেন, ‘আপনি তো চলচ্চিত্রে বেশি কাজ করেন নাই, এত ভালো অভিনয় কিভাবে করেন?’ একদিন সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় পরিচালক এহতেশাম তাকে দেখেন। তাকে চা খেতে ডেকে ‘চাঁদনী’ ছবির জন্য প্রধান চরিত্রে নির্বাচিত করেন। তিনি সে ছবিতে নায়ক নায়িকাদের চেয়েও বেশি টাকা সম্মানী পান। সেই বাঁক বদল হয়ে একটা সময় তিনি বাংলা ছবির অন্যতম জনপ্রিয় খল-অভিনেতা। তিনি তার বন্ধু বিখ্যাত হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে সারা দিন আলাপ করতেন সিনেমায় কীভাবে আরও ভালো কাজ করা যায়। ২০১৮ সালে তিনি খল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার পেয়েছেন। ছবির নাম ছিল ‘একটি সিনেমার গল্প’।

সাদেক বাচ্চুর চলে যাওয়াকে কেন এত বড় ক্ষতি বলছি? কারণ চলচ্চিত্রকে দেখতেন একটা মালা হিসাবে। যেখানে হিরো হিরোইন থাকবেন, কিন্তু সেখানে সবার অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। তাই ওনার বন্ধু হুমায়ুন ফরীদির মতই সিনেমায় এমেচার ভাব দেখতে পারতেন না। যাকে তাকে এনে অভিনয় করানোর ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি দুই সিকোয়েন্সের জন্যেও সিনেমা করেছেন। সবসময় বোঝাতে চাইতেন আউট অফ ফ্রেম কিংবা সাইড ক্যারেক্টারও চলচ্চিত্রে মূল্যবান। বাংলা সিনেমার দুঃসময় নিয়ে বলতে গেলে তিনি বলতেন, ‘সোনালি অতীত—অস্থির বর্তমান—অনিশ্চিত আগামী।

সাদেক বাচ্চুর এই চলে যাওয়া আমাদের চলচ্চিত্র অঙ্গনকে আরও অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেবে। শাকিব খানদের মত নায়কদের গাইডেন্স করা, তাদের দিকটা শোনা, অভিনয় নিয়ে ভাবা, পরিচালকদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আড্ডা দেওয়া, এমন মানুষের শূন্যতা নিঃসন্দেহে অপূরণীয়।

Link copied!