• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫

সলিমুল্লাহ খান: উজানে থাকা বুদ্ধিজীবী


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: আগস্ট ১৮, ২০২২, ০১:২৪ পিএম
সলিমুল্লাহ খান: উজানে থাকা বুদ্ধিজীবী

খালি চোখে আমরা যা দেখি সাধারণত, যা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় ধরা দেয়, আর যাকে দেখি, তার অস্তিত্ব ভিন্ন বৈকি। ইম্মানুয়েল কান্টের ভাবনায় প্রথমটিকে ডাকা হয় ফেনোমেনন, অন্যটিকে ন্যুমেনন। সমাজে বিরাজমান ব্যক্তি, যাকে সকলে নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে দেখে, তার কথা শোনে, সেই মানুষটি নগ্ন নয়নে যে রূপে ধরা দেন, তা-ই ফেনোমেনন বা চোখের দেখা। আর ব্যক্তি স্বয়ং, তার শারীরিক উপস্থিতি, চিন্তাভাবনা ও চর্চার ভেতর দিয়ে যিনি গড়ে ওঠেন, অন্যের দেখার অলক্ষে, নজর-নিরপেক্ষ হয়ে, সেটাই ন্যুমেনন বা চোখের দেখার বাইরের অস্তিত্ব।

সলিমুল্লাহ খানকে খুব কাছ থেকে দেখেছি বলব না, তবে কিছুটা কাছ থেকে দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছে। এবং এই সুবাদে খালি চোখে যারা দূর থেকে দেখেন, তাদের দেখার সঙ্গে আমাদের দেখার পার্থক্য খুব সহজেই ধরা পড়ে। অধিকাংশ সাধারণ দর্শক, গুণমুগ্ধ শ্রোতা ও শত্রুরা যেভাবে সলিমুল্লাহ খানকে দেখেন, তার ভেতর একপেশে ব্যাপার থাকে। কেউ কেউ অনেকটা না বুঝেই তুলনা টানেন অন্য ব্যক্তির সঙ্গে, আবার কেউ কেউ উনি যা বলেন, সেটার যৌক্তিকতাকে পাশ কাটিয়ে, যেভাবে বলেন, সেটা নিয়ে বিষোদগার শুরু করেন। এই দুই পক্ষই আধেয় নিয়ে আগ্রহী নয়। সলিমুল্লাহ খান যা বলেন, তার ভেতরকার সারবস্তু নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। সাধারণ দর্শক সলিমুল্লাহ খানের মনে রাখার মেধাটাই কেবল প্রত্যক্ষ করেন, অন্যদিকে শত্রুরা উনি যা-ই বলেন না কেন, তার ওপর ঢালাও মন্তব্য করেন। 

সলিমুল্লাহ খান যখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুরবস্থা নিয়ে কথা বলেন, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মূঢ় শিক্ষকগণ তাকে বর্জন করেন। উনি যখন দেশের শোচনীয় অবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, তখন ছদ্ম দেশপ্রেমীরা গোস্‌সা করেন। আবার সলিমুল্লাহ খান যখন সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন, বাংলা সাহিত্যের দশা সবার সামনে মেলে ধরেন, তখন সাহিত্যিকরা না শোনার ভান করেন। যখন ভাষার প্রশ্নে সলিমুল্লাহ খান জোর দিয়ে বলেন, মাতৃভাষাকেই হতে হবে শিক্ষার মাধ্যম, তখন একুশে ফেব্রুয়ারিতে কুম্ভীরাশ্রু ত্যাগ করা শিক্ষাবিদরা আরও জবরদস্তি করে ইংরেজিকে জাপটে ধরেন।

মোট কথা, একটি পক্ষের কাছে সলিমুল্লাহ খান লোক হিসেবে মোটেই স্বস্তিদায়ক নন। তিনি সরকার ও উন্নয়নের প্রশস্তি করেন না। উনি তাসের দেশে ইস্কাপনকে হরতন বলে দেন না; যেমন করে এই দেশে দুর্নীতিবাজরা দিনকে রাত, রাতকে দিন করে দেন। তিনি উচিত সমালোচনা করেন এবং বিড়াল বেজার হয়। খালি চোখে সলিমুল্লাহ খান সম্পর্কে অধিকাংশ লোকের ফেনোমেনোলজি বা অভিজ্ঞতাসার হলো সলিমুল্লাহ খান ঠোঁটকাটা, মুখের ওপর সত্য উচ্চারণ করে ফেলেন, কাজেই তাকে এড়িয়ে চলা ভালো, না এড়াতে পারলে ঢালাও গালিগালাজ! মুখপুস্তকের দুনিয়ায় সেটাই তো দেখি!

তবে আমরা যারা কাছ থেকে তাকে বোঝার চেষ্টা করি, আমরা জানি, সলিমুল্লাহ খান সত্য উপলব্ধিকে চেপে রাখতে পারেন না। তিনি নিজের মত দৃঢ়তার সঙ্গেই প্রকাশ করেন। সেটা যত ছোটখাটো বিষয়ই হোক না কেন। একবার এক সাপ্তাহিক পত্রিকার প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আবুল কাসেম ফজলুল হক ছিলেন প্রধান অতিথি এবং সলিমুল্লাহ খান স্যার ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি। প্রথম বর্ষ উপলক্ষে পত্রিকাটি একটি বিশেষ ম্যাগাজিন বের করে এবং সেখানে আমার একটি লেখা ছাপা হয়। স্যার যখন বক্তৃতা শুরু করলেন, তখন পত্রিকাটির খুঁটিনাটি এমনভাবে বলতে শুরু করলেন, আমি লক্ষ করছিলাম আয়োজকদের মুখ ছোট হয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে আমার লেখার রেফারেন্সে নজর দিলেন স্যার। বললেন, রেফারেন্সে একটি অক্ষর ইংরেজি বড় হাতের হবে। যতিচিহ্ন ঠিকভাবে বসেনি। ওই রকম ভরা সভায় আমার লেখার রেফারেন্সের ভুল নিয়ে বলায় আমার একটুও খারাপ লাগেনি, বরং লজ্জা লেগেছে, এই ভেবে যে, এই ভুলটা কেমন করে করলাম! পরে অবশ্য বাসায় ফিরে মিলিয়ে দেখেছি, ওটা ছিল ছাপাখানার ভূতের কাজ! কিন্তু স্যার যে নিরন্তর ছোট ছোট ভুলত্রুটি থেকে শুরু করে বড় বড় অসংগতি ধরিয়ে দেন, এমন মানুষ, এমন শিক্ষক আজকের দিনে বিরল। অন্তত আমার অভিজ্ঞাতায়। যারা পুরাণের জ্ঞানবৃক্ষের কথা শুনেছেন, কিন্তু প্রত্যক্ষ করেননি, তারা সলিমুল্লাহ খানকে দেখলেই বুঝতে পারবেন জ্ঞানবৃক্ষ কি ও কেমন। আমি সেই বৃক্ষের তলায় ফল কুড়ানো বালকমাত্র। ব্যক্তি হিসেবে স্যারকে কাছে পাই বলে ধন্য মনে করি, প্রসন্ন বোধ করি এটা ভেবেও যে আমরা ওনার সময়ে বেঁচে আছি।

আরেক দিনের স্মৃতি বলি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আহমদ ছফার ওপর অনুষ্ঠান শেষ করে আমরা সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আলাপ করছি। কেউ বিদায় নিচ্ছেন। সেদিন দৈনিক পত্রিকায় আমার কোনো একটি লেখা বেরিয়েছে। তো সেই লেখা স্যার পড়েছেন। উনি আমাকে কাছে ডেকে বললেন, লেখাটি ভালো হয়েছে, তবে পত্রিকার সম্পাদক বোধ হয় এই শব্দের উচ্চারণটি জানেন না, ভুল ছেপে দিয়েছেন। আমি বললাম, স্যার সম্পাদকের দোষ নেই। ভুলটা আমারই। 

আরেকবার এক বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী অনলাইন পোর্টালে ছাপানোর জন্য একটি লেখা পাঠালেন। এবং লেখায় তিনি বললেন, doxa শব্দটি ল্যাটিন। লেখাটি প্রকাশের পরপরই স্যার আমাকে ফোন করে বললেন, উনি কি সামান্য গুগল করেও দেখতে পারেননি যে শব্দটি গ্রিক? তখন আমি আবার ভাষাবিজ্ঞানীকে ফোন দিলাম এবং স্যারের নাম উহ্য রেখে বললাম, এটা তো মনে হয় গ্রিক শব্দ। উনি তখন কিছুটা উষ্ণ স্বরেই বললেন, গ্রিক ও ল্যাটিন দুটোই বলা যায়। জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে আমি আপনার লেখায় কোনটা রাখব? উনি ঈষৎ ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, দুটোই রাখুন। আমি দুটোই রেখে দিয়েছি।

ভুল মেনে নেওয়ার মানসিকতা এই ভূখণ্ডে বিরল। তবে আমি ভাগ্যবান, কারণ আমার ভুল ধরিয়ে দেন স্বয়ং সলিমুল্লাহ খান। এমন স্নেহ নিয়ে ভুল ধরিয়ে দেওয়ার মানুষ আর কোথায়? যতবার স্যার ভুল বা ত্রুটি ধরিয়ে দেন, আমি কৃতজ্ঞতায় মস্তক অবনত করি। ব্যক্তি সলিমুল্লাহ খানকে খানিকটা চিনি বলে বলতে পারি, তিনি ভুলের সমালোচক, ভুল যিনি করেন, তার নন। কিন্তু এই উপলব্ধি কেন সবার হতে যাবে? কাজেই ভুল-বোঝাবুঝি সুদে-আসলে বাড়ে। অনেকের সঙ্গে রচিত হয় দূরত্ব। স্যার বলেন, এই কারণেই তার বন্ধুত্ব টেকে না। 

সম্প্রতি দেশের অর্থনীতির নাজুক পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা করায় শাসক দলের বিরাগভাজন হয়েছেন। এ আর নতুন কি! দেশে অন্য বুদ্ধিজীবীরা তো এমন করে বলছেন না। যখন সলিমুল্লাহ খান উজানে, তখন বাকিরা উন্নয়নের জোয়ারে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তাই কেউ তার মতো সাহস করে বলতে পারেননি, উন্নয়নের স্বপ্ন মরীচিকা মাত্র। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে আহমদ ছফা বলেছিলেন, “বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।” স্রোতের বিপরীতে থাকা বুদ্ধিজীবীরা এভাবেই বলেন। আহমদ ছফাকেই প্রতিধ্বনি করেন সলিমুল্লাহ খান। কিন্তু সেই ধ্বনি প্রবেশ করছে কয়জনের কর্ণকুহরে? 

সাধারণ জনগণের নজরের বাইরে দীর্ঘ পথপরিক্রমায় সলিমুল্লাহ খানের যে স্বতন্ত্র গড়ে ওঠা, ব্যতিক্রমী চিন্তা করার প্রক্রিয়া, তার ছাপ পাওয়া যায় লেখাপত্র ও বক্তৃতায়। অনেককেই বলতে শুনেছি সলিমুল্লাহ খানের বক্তৃতা শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু তার লেখা বুঝি না। মূলত এই দলটির কথা দিয়েই এই অধ্যায় শুরু করেছিলাম, এরা সাদা চোখে সলিমুল্লাহ খানকে দেখেন। কালো চোখে অর্থাৎ চক্ষু মুদিয়া সলিমুল্লাহ খানের সত্তাকে দেখার চেষ্টা করেন না, ফেনোমেননের বাইরে গিয়ে ন্যুমেননকে বোঝার কোশেশ করেন না। তাই ব্যক্তি থেকে সংগঠন, সবার ভেতরেই একধরনের সলিমুল্লাহ-ভীতি কাজ করে। কিন্তু তার বক্তব্যের ভেতর, খুব কম মানুষই আছেন, যারা অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। খুব কম মানুষই তার বক্তব্যের অভিমুখকে অনুধাবন করতে পারেন। 

আরেকটি স্মৃতি দিয়েই এই পর্বের সমাপ্তি টানছি। ২০১৮ সালে আমরা কাকের (CAAC) পক্ষ থেকে কার্ল মার্কসের জন্মের দুই শ বছর উদ্‌যাপন করেছিলাম। দিনব্যাপী সেই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের বাম বুদ্ধিজীবীদের প্রায় সবাই উপস্থিত ছিলেন। বিকেলের অধিবেশনে স্যার বক্তৃতা করলেন। দর্শক সারিতে আমার পাশে বসে থাকা এক পার্টির কমরেড বললেন, সলিমুল্লাহ খানের এই এক সমস্যা, তিনি একটি বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে, অনেক বিষয় এনে মূল বিষয়টিকে হারিয়ে ফেলেন। 

আমি তাজ্জব হয়ে তার দিকে তাকালাম, কারণ স্যারের বক্তৃতা এত সুন্দর হয়েছে যে আমি মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। পাশের কমরেড কেন বুঝতে পারলেন না! এর একটি কারণ হতে পারে স্যারের বক্তৃতার কাঠামো। ছকটা যে ধরতে পারে না, সে বক্তৃতা শুনে খেই হারাবে। স্যার বক্তৃতা করেন সাগরে জাল ফেলার ঢঙে। তিনি জালটা ফেলেন অনেকখানি ছড়িয়ে। তারপর ধীরে ধীরে জাল গোটাতে থাকেন। সেখানে উঠে আসতে থাকে নানা মণিমানিক্য। শেষে যখন জাল গোটানো শেষ হয়, দেখা যায়, বিভিন্ন অঞ্চলকে তিনি সংযুক্ত করে একটি সারাংশে পৌঁছাচ্ছেন। পৃথিবীতে খুব কম মানুষই এমন চমৎকার প্রণালিবদ্ধ বক্তৃতা দিতে পারেন। সলিমুল্লাহ খানের ভিন্নধর্মী চিন্তা প্রক্রিয়া ও কাঠামোর কারণেই হয়তো তার সম্পর্কে দূরের মানুষের একধরনের পাঠ আছে। এবং আমি হলফ করে বলতে পারি, সেই পাঠ অনেকেরই দুর্বোধ্যের তালিকায় রাখা। এখন কেউ যদি বাড়ির কাজ ও প্রস্তুতি ছাড়া উচ্চতর পাঠ হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করেন, সেই দোষ তো আর পাঠ্যবইয়ের নয়।

স্যারকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।

Link copied!