• ঢাকা
  • শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শনিবার অন্তিম সময় থেকে রোববার ভোর


ফজল হাসান
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২, ০৭:৫৩ পিএম
শনিবার অন্তিম সময় থেকে রোববার ভোর

মূল : ওলগা তোকারজুক
অনুবাদ : ফজল হাসান

ঈশ্বর শনিবার মধ্যরাতের কয়েক মিনিট পরে এক সংযোজনের মাধ্যমে বিশেষ ধরনের ওষুধ তৈরি করেছিলেন—অন্য কথায়, রোববারে, যখন তার আর কোনো কিছু করার কথা ছিল না। কেননা, সৃষ্টির কাজ শেষ সীমানায় পৌঁছেছিল। সুতরাং বলা যায়, ঈশ্বরের মাদকদ্রব্য তৈরির কাজ আইন ও শৃঙ্খলা উভয়ই লঙ্ঘন করেছিল।
আসল কথা হলো, ছয় দিনের প্রকল্পে কাজ শেষ করার পরে তিনি যে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন, তা কোনোভাবেই অজুহাত হতে পারে না। 
ঠিক মধ্যরাতের আগে যখন ঈশ্বর এক ঢোঁক আরও শক্তিশালী তরল পদার্থ পান করার জন্য রান্নাঘরে ঢুকেছিলেন, তখন অকস্মাৎ তিনি সন্দেহের জালে আটকা পড়েছিলেন। তার গর্ব ও সন্তুষ্টির অনুভূতিকে দখল করেছিল এক অদ্ভুত এবং সংজ্ঞাহীন অস্বস্তি। 
ঈশ্বর তার আঙুলের ডগা দিয়ে পাইপের চারপাশে জড়িয়ে ধরেন। কিছুক্ষণ পর তিনি তার দরজায় ঝাঁকুনির শব্দ শুনতে পেলেন: প্রতিবেশী এসেছেন। মহিলা বেশ কয়েক দিন ধরে এ সময়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তার প্রকল্প কেমন চলছে, তা দেখার জন্য মহিলার আগমন।
‘আপনাকে সুস্থ দেখাচ্ছে না,” মহিলা ভেতরে প্রবেশ করেই বললেন, কারণ তিনি কখনো মিষ্টি কথার ফুলঝুরি ছড়ান না। “আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি ভীষণ ক্লান্ত, জীর্ণ-বিধ্বস্ত। আপনার কাজ কী শেষ হয়েছে?”
“আমার কাজ শেষ হয়ে গেছে,” বলেই ঈশ্বর হাসলেন এবং মহিলার জন্য একটি চেয়ার টেনে আনেন। চিরকাল ধরে তারা একে অপরকে জানেন, এমনকি একবার একে অপরকে কামনাও করেছিলেন। কিন্তু এখন সেই ধরনের কাজকর্ম করার জন্য তারা বড্ড বুড়ো হয়ে গেছেন।
“সুতরাং? কেমন করে শেষ হয়েছে?”
“আমি অবিশ্বাস্যভাবে পরিশ্রান্ত। আর,” ঈশ্বর সতর্কভাবে যোগ করেন, “আমার মনে হচ্ছে একটা কিছু থেমে গেছে।”
ঈশ্বরের প্রতিবেশী অত্যধিক স্নেহপরায়ণ হয়ে তার হাতে আলতো করে চাপড় দেন, তারপর উঠে দাঁড়ান, দরজার পাল্লা খুলে বাইরের দিকে খোলেন এবং ভেতরে উঁকি মারেন। মহিলার অন্ধকার মুখটি পৃথিবীর অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসা আলোর ঝলকানিতে ঝলমল করছিল। তিনি বেশ অনেকটা সময় নীরব ছিলেন এবং সেই নীরবতার ফাঁকে সবকিছু গ্রহণ করেছিলেন।
“বিষয়টি ভালো নয়,” মহিলা অবশেষে ঈশ্বরকে বললেন । “কোনো অপরাধ নেই। সবকিছুই অনেক বেশি পরিমাণে আছে। তবে খুবই তীব্র এবং বলা যায় অত্যন্ত চাকচিক্যপূর্ণ। অত্যধিক নান্দনিক। বেশির ভাগ মানুষই তা সহ্য করতে পারবে না।”
“বাস্তবতার মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো এটি ধারণ করা যায় না,” ঈশ্বর কিছুটা অপমানিত স্বরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। “সে জন্যই আমি এর সঙ্গে সময় যুক্ত করেছি। সবকিছুরই স্থায়ীত্ব এক মুহূর্ত — সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রাখার এটাই শ্রেষ্ঠ উপায় ।”
ঈশ্বরের প্রতিবেশি মহিলা দরজার পাল্লা ছেড়ে দিয়ে টেবিলে ফিরে যান। তিনি উভয়ের জন্য গ্লাসে পর্যাপ্ত পরিমাণে কঠিন পানীয় ঢালেন ।
“আপনি কী মনে করেন না যে, আপনি তাদের সামান্য বেশি ক্ষমতা দিয়েছেন? আমি বলতে চাচ্ছি যে, এসব উলঙ্গ দ্বিপদ প্রাণীদের। আপনি কী মনে করেন না যে, আপনি হয়তো তাদের আত্মহারা করেছেন? তারা আপনার ভাবমূর্তিতে উপস্থিত থাকুক? অথচ আপনার ভাবমূর্তিতে তাদের উপস্থিতি একেবারেই নেই । আপনি শুধু নিজের দিকে একবার তাকান ...”
“আপনার উদ্বিগ্নতার জন্য কোনো কাজ না করা কিংবা কিছুই সৃষ্টি না করা ভালো,” ঈশ্বর তীব্র কণ্ঠে বললেন। “আপনি হয়তো একবারের জন্য আমাকে উৎসাহিত করতে পারেন। আমি সব সময় খুব বেশি চেষ্টা করি এবং কখনো কোনো ইতিবাচক অতিরিক্ত শক্তি পাই না।”
“কখনো বলবেন না যে, কখনো নয় কিংবা সব সময়। আপনি খুব ভালো করেই জানেন, এ ধরনের ধারণার কোনো অস্তিত্ব নেই ।”
ঈশ্বরকে বিচলিত দেখায়।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে,” প্রতিবেশী তার গলার স্বর পরিবর্তন করে বললেন। “সেখানে কিছু ভালো জিনিস আছে। আপনি যা কিছু তৈরি করেছেন, তার মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেছি ব্যাঙের ছাতা। সত্যিই এটি আশ্চর্য শিল্পকর্ম। আসলে আমি বলতে চাচ্ছি, সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় সত্ত্বেও আনন্দদায়ক।”
ঈশ্বরের মুখ রঙিন হতে শুরু করে।
“আপনি যখন সৃষ্টি করেছেন, তখন কী ভেবেছিলেন? আপনি কেন ব্যাঙের ছাতা হিসেবে এমন এক জিনিস সৃষ্টি করেছেন?”
“কারণ খুবই সুন্দর?” ঈশ্বর সাহসী গলায় বললেন। “কেননা এটি দেখতে প্রচন্ড লাল এবং এতে অতি ক্ষুদ্র বিন্দু আছে?”
ঈশ্বরের প্রতিবেশী নিশ্বাস ছাড়েন এবং গ্লাসের দিকে হাত বাড়ান। 
“যা-ই হোক না কেন, কে ব্যাঙের ছাতা তোয়াক্কা করে?” এক মুহূর্ত পরে ঈশ্বর আশ্চর্য্যান্বিত কণ্ঠে বললেন, যদিও তার প্রতিবেশীর প্রশংসা ছিল প্রাণবন্ত। আপনি কি ব্যাঙের ছাতার ছোট বন্য চাচাতো ভাই-বোনদের, সূঁচালো ছত্রাক এবং তার দরিদ্র আত্মীয়স্বজনদের দেখেছেন? আপনি কী দেখেছেন তাদের ক্ষুদ্র পা কতটা পাতলা? হয়তো আপনি তাদের পা দেখতেও পাবেন না। তারা সেসব ক্ষুদ্র পা ছাড়াও বেঁচে থাকে পারে এবং তবুও তাদের পা আছে ।”
ঈশ্বরের কন্ঠস্বরে উত্তেজনা। কিন্তু তিনি যেই শেষ বাক্যটি সমাপ্ত করলেন, তখনই তার উৎসাহ পুনরায় হ্রাস পেতে শুরু করে। অবশেষে তিনি ভারী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন:
“কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা শুধুমাত্র ব্যাঙের ছাতা হয়। সবকিছু মিলিয়ে এত ভালোভাবে সম্পন্ন হয়নি, তাই না? আমি নষ্ট করে ফেলেছি ... আসল কথা হলো, মানব গোষ্ঠী খুবই উদ্বিগ্ন ছিল এবং টুপি ছুড়ে ফেলার সময় তারা ছিল আক্রমণাত্মক, অসন্তুষ্ট আর লোভী। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে এবং তার জন্য তারা নিজেরাই কষ্ট ভোগ করবে। তারা আমাকে সব সময় ডাকবে এবং আমি তাতে বিরক্ত হব।”
“আসুন, আপনি কেবল বলতে পারবেন না যে, আপনি ভুল করে তা করেছেন,” ঈশ্বরের প্রতিবেশী মহিলা বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন। “তার ওপর যদি এমন হয়, তবে আপনি তা মেরামত করতে পারেন। যেখানে ইচ্ছা আছে ...”
“অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজ রোববার।”
“ওহ্, দয়া করুন। আপনিই একমাত্র দায়িত্বে আছেন।”
ঈশ্বর নিস্তেজ দৃষ্টিতে টেবিলের ওপর তাকালেন।
“সেসব ব্যাঙের ছাতা... আপনি ভালো যা করেছেন, তাই থাক,” ঈশ্বরের প্রতিবেশী বললেন। “যদি আপনি কয়েকটি বিশেষ ওষুধ নিয়ে আসেন এবং আপনার কিছু শিল্পকর্মের ওপর তাদের ছিটিয়ে দেন, তখন কী হবে? মানুষকে কিছুটা আচ্ছন্ন করার জন্য তাদের কিছু বিশেষ মুহূর্তে থাকতে দিন?”
ঈশ্বর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকালেন এবং সেই তাকানো ছিল তার চোখের পলক। 
“হ্যাঁ,” ঈশ্বর বললেন, “এবং ওগুলো সৃষ্টি করা হয়েছে যেন সব সময় গ্রহণ করে, খুঁজে বের করে, স্বপ্ন দেখে, সংঘবদ্ধ করে, দুর্বল করে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে বিভ্রান্ত করে।”
“আসলে আমার মনের মধ্যে তা ছিল না। আমি বলতে চেয়েছিলাম— ”
“কিন্তু এভাবেই আমি একটার মূল্যে দুটি পাব,” ঈশ্বর প্রতিবেশী মহিলার কথায় বাধা দিয়ে বললেন। “আমি ওদের সীমার মধ্যে রাখতে পারি। ওরা আশা করবে না যে, নিচ থেকে ওভাবে বেরিয়ে আসবে। ওরা নিজেদের প্রতি মনোযোগ দেবে এবং আমাকে আর বিরক্ত করবে না। আমি ঠিক যেখানে চেয়েছি, সেখানেই ওদের রেখেছি। আমার প্রিয়তমা, তুমি প্রতিভাময়ী। সময় কত?”
ঈশ্বরের প্রতিবেশী ভারী দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়েন।
“রাত বারোটা বেজে পাঁচ মিনিট। এখন রোববার।”
“সবকিছু গোল্লায় যাক!”
“আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে আপনি সময়ের জন্য কেবল সংযোজন করতে পারেন। মোট কথা, আপনিই হলেন ঈশ্বর।”
“আপনি কি তাই মনে করেন?”
ঈশ্বর তড়ক করে লাফিয়ে ওঠেন এবং কাজ শুরু করেন। তিনি কেটলি পূর্ণ করেন এবং তারপর কিছু খালি টিনের পাত্র ও বয়ামে কিছু জিনিস মেশাতে শুরু করেন। সব সময় তিনি আপনমনে বিড়বিড় করেন: “ওপিয়েটস,” “লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথাইলামিড” এবং পরবর্তীতে কিছু সূত্র, যেগুলো বোঝা অত্যন্ত কঠিন ছিল। তিনি তার কাপে বেশ কয়েক ধরনে পদার্থ দিয়ে মুখ বন্ধ করেন এবং পরে ভালোভাবে মেশান।
“আমি কীভাবে বিতরণ করব? আমি এর মধ্যে কী রাখব? আপনি কী ভাবছেন? জলদি করুন। আপেল সমস্যা শুরু হওয়ার আগেই কার্যকর করতে হবে।”
“শুধু ঢাকনাটি তুলুন এবং নিক্ষেপ করুন। যেখানে পড়বে, তা বিবেচনার বিষয় নয়। তারা কাকতালীয় শব্দটি পছন্দ করবে। বিষয়টি আরও ভালো হবে, যদি তারা আপনার সঙ্গে এর কোনো সংযোজন না করে, যেকোনো ক্ষেত্রে, যদি তারা বুঝতে না পারে যে, আপনি উদ্দেশ্যমূলকভাবে করেছেন।”
“তারা আমার উদ্দেশ্য সম্পর্কে খারাপ মনে করতে পারে,” ঈশ্বর সম্মতি জানান। তিনি নতুন তৈরি পদার্থ থেকে এক চিমটি তুলে নেন এবং দরজার নিচে যা কিছু ছিল, তার সঙ্গে মেশান। দেখে মনে হচ্ছিল যেন তিনি কোনো খাবারে লবণ দিয়েছেন। তার প্রতিবেশী বিশ্বের ওপর ঝুঁকে পড়েন এবং পাউডার পড়ে যেতে দেখেন।
“সেই অম্ল পদার্থ ভুট্টার ঠিক মাঝখানে অবতরণ করে এবং অন্য কিছু জিনিস চমৎকার আফিমক্ষেতে উড়ে গিয়ে পড়ে।”
“ওহ্, আমার গ্লাস…আর আমার ব্যাঙের ছাতা! তাকিয়ে দেখুন!”
ঈশ্বর যখন শেষ করলেন, তখন তিনি ছিটকানি বন্ধ করেন এবং তারা দীর্ঘ সময় ধরে নীরবে বসে ছিলেন। তাদের চারপাশে রোববার যেন ফুল হয়ে প্রস্ফুটিত হয়।
“কাজ করার সময় আমার ভুল হতে পারে,” ঈশ্বর হঠাৎ বলেন।
“দয়া করে,” জবাবে তার প্রতিবেশী বললেন এবং পরম আশ্বাসে তিনি ঈশ্বরের হাতের ওপর নিজের হাত রাখেন। “একপর্যায়ে আপনাকে সত্য কথাটি গ্রহণ করতে হবে যে ঈশ্বর ভুল করেন না।”
এবং তারপর মহিলা উঠে দাঁড়িয়ে যোগ করেন, “বিছানায় যাওয়ার সময় হয়েছে।”

লেখক পরিচিতি: নোবেল বিজয়ী পোলিশ ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, বামপন্থী অধিকারকর্মী এবং বুদ্ধিজীবী ওলগা তোরাকজুক (পুরো নাম ওলগা নভোয়া তোরাকজুক) ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন। তার প্রথম উপন্যাস দ্য জার্নি অব দ্য বুক পিপল’ প্রকাশিত হয় ১৯৯৩ সালে। ইংরেজিতে অনূদিত ‘ফ্লাইটস্’ তার সবচেয়ে সফল এবং সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ২০১৮ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল বুকার’ পুরস্কার এবং ২০১৯ সালে ঘোষিত ২০১৮ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন। ইংরেজিতে অনূদিত তার অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘হাউস অব ডে, হাউস অব নাইট’, ‘প্রিমেভাল অ্যান্ড আদার টাইমস’, ‘ড্রাইভ ইয়োর প্লাউ ওভার দ্য বোনস অব দ্য ডেড’, ‘দ্য লস্ট সৌল’ এবং ‘দ্য বুক অব জ্যাকব’। তিনি অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। 

গল্পসূত্র: ‘শনিবার অন্তিম সময় থেকে রোববার ভোর’ গল্পটি ওলগা তোকারজুকের ইংরেজিতে অনূদিত ‘লেইট স্যাটারডে টু আর্লি সানডে’ গল্পের অনুবাদ। গল্পটি পোলিশ ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জেনিফার ক্রফ্ট। গল্পটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘বম্ব’ ম্যাগাজিনে (৭ জুন ২০১৬) প্রকাশিত হয় এবং সেখান থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।
 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!