রশীদ হায়দারকে অনেকে অনেক কারণে মনে রাখবেন। কেউ কেউ মনে রাখতে পারেন বিখ্যাত জিয়া হায়দারের ভাই হিসেবে, কেউ মনে রাখতে পারেন অগ্রজ কথা সাহিত্যিক হিসেবে, কেউ মনে রাখবেন তার একুশে পদক ও বাংলা একাডেমির বড় পোস্টে দীর্ঘদিন চাকরি এবং নির্বাহী পরিচালক হিসাবে নজরুল ইনসিটিটিউটের প্রাতিষ্ঠানিকতায়।
আমার কাছে তিনি সব সময় স্মরণযোগ্য হবেন তার দুটো অসাধারণ কাজের জন্য। যে দুটো বই আমাকে শাণিত করেছে, মুক্তিযুদ্ধের কথা আরও বেশি করে ভাবতে শিখিয়েছে—প্রথমটা হলো যুদ্ধের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছুটা সামাজিক ইতিহাসের বই, ‘১৯৭১ : ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’, আরেকটা হলো ওনার সম্পাদিত সিরিজ, ‘স্মৃতি৭১ (১৩ খণ্ড)’। শেষোক্ত বইটার মতো দারুণ কাজ আমি বাংলা একাডেমিতে আর খুঁজে পাই না। দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে তাদের আত্মীয় ও বন্ধুরা লিখেছেন। মানুষ হিসাবে কে কেমন ছিলেন তার অনন্য সব বর্ণনা। আমার যদি ক্ষমতা থাকতো এই সিরিজটা আমি সারা বাংলাদেশের স্কুলে দিয়ে বেড়াতাম। বইগুলো পড়লে আপনি হতচকিত বোধ করবেন। কি একটা সময় গেছে আমাদের। আমরা এই জাতি রাষ্ট্র গড়তে পারিনি সেই দায় আমাদের, কিন্তু যে বুদ্ধিজীবীরা একাত্তরে প্রাণ দিয়েছেন তারা কি সোনার মানুষ ছিলেন।
একজন হিন্দু শিক্ষকের গল্প পড়েছিলাম, তাকে এক মুসলিম পরিবার আশ্রয় দিয়েছিল, তিনি গোপনেই ছিলেন, এক রাজাকার কীভাবে জানি দেখে ফেলেন এবং পাকিস্তান আর্মি তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলে। সেই মুসলিম পরিবার পরে শিক্ষকের পরিবারের কাছে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নাকি বলেছিলেন, স্যারকে বাঁচাতে পারলাম না মনে হয় আমার নিজের হাতেই স্যার মরলো। এই যে আবেগ এর গল্প রশীদ হায়দার ছাড়া কেউ জানায় নাই আমাদের।
সাহিত্যের রশীদ হায়দার কেমন? ‘খাঁচায়’ (১৯৭৫), ‘অন্ধ কথামালা’(১৯৮১) এবং ‘নষ্ট জোছনা এ কোন অরণ্য’(১৯৮২)—মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক এই ত্রয়ী উপন্যাসে যুদ্ধের ইতিহাসকে মানবজীবনের অঙ্গীভূত করে তোলার নিবিড় ঐকান্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। পাকিস্তানিদের দ্বারা অবরুদ্ধ নগর জীবনের রূপকার হিসেবে বস্তুনিষ্ঠ। উপরন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের সংকট উন্মোচনে ভীষণ দরদী। একটি উদ্ধৃতি—‘রাস্তাঘাট সব বন্ধ। ... এই যে সামনে খোলা মিরপুর রোড, দক্ষিণ থেকে সোজা উত্তরে যাচ্ছে; কিন্তু আটকে গেছে মিরপুর ব্রিজের মুখে গিয়ে; সামনে পেছনে পাশে রয়েছে উদ্যত ভয়াবহ সঙ্গিন। অথচ সেটা পার হতে পারলেই মুক্তি, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারার পূর্ণ অধিকার। রায়ের বাজার পার হয়ে নদী অতিক্রম করে ওপারে যেতে পারল চিৎকার করে বলা যায়, আমি আর পাকিস্তানিদের হাতের মুঠোয় নেই...। নারায়ণগঞ্জ দিয়ে কোথাও চলে যাওয়া যায় না? বাংলাদেশে কি তেমন ব্যক্তি নেই যে, এই খাঁচায় পোরা মানুষগুলিকে একটু আশ্রয় দিয়ে মুক্ত ও উদার দিগন্তে চলাফেরা করার সুযোগ দেবে না? ওদিক অবরুদ্ধ? বনানী গুলশান হয়ে? ক্যান্টনমেন্ট শিকার ধরার জন্য ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছে ওখানে ধরা পড়লে এক খাঁচা থেকে আরেক খাঁচায়।”
তবে তাঁর ‘অন্ধ কথামালা’র পটভূমি গ্রামীণ জীবনে বিস্তৃত-বিশেষত নিজের জন্মভিটার আঙিনা পাবনার নিকটবর্তী এলাকার মুক্তিযুদ্ধের অভিঘাত চিত্রিত হয়েছে। গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ও শান্তি বাহিনীর তৎপরতার কাহিনীতে দেখা যায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিশ্বস্ত সহচর কীভাবে প্রলুব্ধ হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তবে তার কারণে মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু হলেও শত্রুমুক্ত দেশের স্বপ্ন লেখকের চেতনায় দীপ্ত- ‘মানুষ অদৃশ্য হয়ে গেলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। মানুষকে দেখতে না পেলেও মানতেই হবে সে আছে আশেপাশে, আশ পাশ থেকে একসময় বেরিয়ে বলবে, আমি নদীর তরঙ্গ দেখছিলাম, আমি কালকুলের নাচন প্রত্যক্ষ করছিলাম, আমি মোসলেম হোমিওর মেয়ে শরীফাকে দেখতে গিয়েছিলাম, আমি দেশের জন্য যুদ্ধে গিয়েছিলাম ‘
‘অন্ধ কথামালা’র যুদ্ধ বাস্তবতার পরিসর চিত্রণের পর সেখান থেকে ভিন্ন মাত্রায় যুদ্ধোত্তর সময়ের রূপায়ণে ‘নষ্ট জোছনা এ কোন অরণ্য’ উপন্যাসটির দুটি অংশের বিন্যাসে রশীদ হায়দারকে আরও বেশি সাফল্য এনে দিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হতাশা, কষ্ট, আদর্শচ্যুতি এবং একাত্তর পরবর্তী সামাজিক অবক্ষয় বিশেষত স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থানের ইতিহাসকে আখ্যানে স্থান দেওয়ায় প্রথম অংশের উপস্থাপন সত্যিই প্রশংসনীয়। সেখানকার একটি সংলাপ, “আর দুই এক বৎসর যাক, দেখবি মুক্তিযোদ্ধা বললে কর্তারা দেশদ্রোহী বলে আখ্যা দেবে।” অন্যদিকে ‘এ কোন অরণ্য’ অংশে মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি আদায়ের প্রাণিত চিত্রণ রয়েছে। যেমন- “কোনো অনুগ্রহই চায়নি হাতেম, কেবল চেয়েছিলো ওরা বলুক আমারে গাঁয় ছাওয়াল হাতেম দ্যাশের জন্য যুদ্ধ করেছিলে।” নিম্নবর্গ মানুষের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ন্যায্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি আদায়ের যে চেষ্টা এ অংশে বর্ণিত হয়েছে তা প্রকৃতপক্ষে অনন্য।
সামরিক শাসনে পিষ্ট জাতি যখন মুক্তিযুদ্ধকে নেহায়েত একটা ‘গণ্ডগোল’ ভাবছিল, তখন তার এই উদ্যোগ, লেখালেখি ও সম্পাদনা একটা মাইলফলক। কি যত্ন নিয়ে তিনি এ কাজটা করেছেন, দীর্ঘদিন যারা এড়িয়ে যেত তারা অব্ধি লিখেছে তাদের স্বজনকে নিয়ে। নবনীতা চৌধুরী, তিনি একমাত্র সেলিব্রিটি যে ব্যাপারটা নিয়ে লিখেছেন রশীদ হায়দারের মৃত্যুর সাথে সাথে। কি দারুণ ছিল লেখাটা, শিরোনাম ছিল, অভিবাদন প্রিয় মানুষ রশীদ হায়দার। রশীদ হায়দার বেঁচে থাকবেন এই বাংলার আনাচে কানাচে শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির সুরভীতে। ১৩ অক্টোবর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী ছিল, অন্তর থেকে শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ।








































