• ঢাকা
  • শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আমার ভাষা ফিকশন ব্লেন্ডেড উইথ রিয়ালিটি: কামার আহমাদ সাইমন


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: মার্চ ১৩, ২০২২, ০৪:৪৮ পিএম
আমার ভাষা ফিকশন ব্লেন্ডেড উইথ রিয়ালিটি: কামার আহমাদ সাইমন

ব্যক্তিগত আলাপ অনেক সময় ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে যায়, চিন্তার গণ্ডিকে নতুন করে চিহ্নিত করে, ব্যপ্ত করে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমানাকে। সেই বিবেচনায় নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমনের সাথে চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরুর ব্যক্তিগত আলাপকে সাক্ষাৎকারে রূপ দেওয়ার একটি প্রয়াস এটি। প্রেক্ষাপট নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব মুভিং ইমেজের (মমি) ফার্স্ট লুক ফেস্টিভ্যালে প্রথম বাংলা ছবি কামার আহমাদ সাইমনের ‘অন্যদিন...’।


বিধান রিবেরু: মমি'র ফার্স্ট লুক ফেস্টিভ্যালে প্রথম বাংলা সিনেমা হিসাবে 'অন্যদিন...'এর জন্য শুভেচ্ছা। 'অন্যদিন...'কে কি আমরা প্রামাণ্যচিত্র বলবো, না কাহিনীচিত্রের মিশ্রণ?

কামার আহমাদ সাইমন: 'অন্যদিন...'কে জনরা দিয়ে ব্যাখ্যা করা কঠিন, আপনি এইটাকে হাইব্রিড ফিকশন বা নন-ফিকশন, যে কোনোটাই বলতে পারেন। আসলে 'শুনতে কি পাও!' মুক্তির পর থেকেই, এটা ফিকশন, না নন-ফিকশন এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে, আমি খুব আমোদ নিয়েই এই আলোচনাগুলা উপভোগ করেছি প্রথমে। কিন্তু পরে আমাদের নির্মাতা-সমালোচকদের 'ওলড-স্কুল' মাইন্ড-সেট দেখে, ছবিটাকে আইডেন্টিফাই করতে না পারাটায় আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি আর সংস্কৃতি চর্চার দীনতায় হতাশই হয়েছি। 'শুনতে কি পাও!' ছবিটাতো পুরাটাই একটা ম্যানুফাকচারড রিয়ালিটি, বা যাকে অনেকদিন ধরেই চলচ্চিত্র দুনিয়া ব্লেন্ডেড উইথ রিয়ালিটি বলছে। সেই অর্থে 'অন্যদিন...' বরং টেকনিক্যালি অনেক বেশি ফিকশনালাইজড, কাস্টিং, স্ক্রিপ্টিং এবং শ্যুটিং সকল অর্থেই। যদিও এই দুটি ছবির কোনটাতেই ডকুমেন্ট বা প্রমাণ অর্থে কিছু নাই, আমার স্কুলিংটাও তা না... আমি এপ্রোচই করি ফিচার হিসাবে…

 

রিবেরু: আপনার স্কুলিং নিয়েও বোধ হয় একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন ফরাসি কোন সাংবাদিক, প্যারিসের জর্জ পম্পিদ্যু সেন্টারে প্রদর্শনীর সময়।

সাইমন: জর্জ পম্পিদ্যু সেন্টার যেহেতু প্যারিসের অন্যতম প্রধান সংস্কৃতি কেন্দ্র, তাই ঐ সাংবাদিকের কথায় মেজাজ চড়ে গিয়েছিলো। উনি জানতে চেয়েছিলেন, আসলে বলতে চেয়েছিলেন যে আমার ছবিতে ‘ফিকশন-ননফিকশন’ চলচ্চিত্র-ভাষার যে প্রয়োগ, সেটা কোনোভাবে ইউরোপীয় সিনেমা ভেরিতে ধারায় প্রভাবিত। উত্তরে আমি বলেছিলাম, শুধু ইউরোপে না, অন্য কোনো স্কুলেই প্রচলিত অর্থে চলচ্চিত্র শিক্ষার ‘সৌভাগ্য’ আমার হয়নি। তবে আমার ওয়ারিশান লালনের গান, সুলতানের ডিকলোনিয়াল পেইন্টিং, সাবঅল্টার্ন প্রেমিসে তারাশঙ্করের উপন্যাস ‘কবি’, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লাল সালু’, যাদের কাজ সম্পর্কে ইউরোপ একরকম অন্ধকারেই আছে। অথচ ওয়ালিউল্লাহ বিয়ে করেছিলেন একজন ফরাসী ভদ্রমহিলাকে, মারা গেলেনও প্যারিসেই। সেদিন দর্শকসারিতে বসেছিলেন প্যারিসপ্রবাসী অগ্রজ চিত্রশিল্পী শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মূকাভিনয়শিল্পী পার্থ প্রতিম মজুমদার, ফ্রান্সে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতসহ অনেক বাঙালি। তাঁদের মুহুর্মুহু করতালিতে বুঝেছিলাম, ইউরোপে থেকেও তাঁরা একরকম সাবঅল্টার্ন বা ডিকলোনাইজেশন ব্যাপারটা এখনো শুধুমাত্র পাঠ্য। এর প্র্যাকটিস আমাদেরকেই শুরু করতে হবে, অন্য কেউ করে দিবে না।

 

প্যারিসে জর্জ পম্পিদ্যু সেন্টারে 'শুনতে কি পাও!' প্রদর্শনীর আগে কামার আহমাদ সাইমন। পাশে 'অন্যদিন...' ছবির পোস্টার।

রিবেরু: ফিকশন ও নন-ফিকশনের মিশ্রণ এখন নতুন ধরনের জঁরার জন্ম দিচ্ছে। আপনিও সেই পথে হাঁটছেন।

সাইমন: এই পথে আমি শুধু একা নই, শিল্পসাহিত্যের অন্য জায়গাতেও এমনটা ঘটছে। শাহাদুজ্জমানের 'একজন কমলালেবু'কে আমাদের অগ্রসর পাঠক যখন 'সাহিত্য' না বলে খারিজ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন, তখন তাঁরা ভুলে যান সুনীলের 'সেই সময়' বা 'প্রথম আলো'র কথা! বেলারুশ বংশোদ্ভূত রুশ লেখিকা সেতলিনা আলেক্সিভিচকে যখন সাহিত্যে নোবেল দেওয়া হয় তখন কিন্তু কোন বিশেষ ক্যাটাগরাইজ করে দেওয়া হয় না, বরং আর দশটা সাহিত্যের সাথে তুলনামূলক বিচারে একজন পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যিক হিসাবেই দেওয়া হয়। অথচ তাঁর প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজই সংজ্ঞায় ফেললে নন-ফিকশন, স্রেফ সাক্ষাৎকার। আপনি যদি তিরিশ বছর আগে বানানো কিরোস্তামির ‘কোকার ট্রিলজি’র কথা বাদও দেন, যদি শুধু গত দশ বছরের লিড ফেস্টিভ্যালগুলোর দিকে তাকান, দেখবেন যে নন-ফিকশন ছবিগুলা ফিকশন ছবির সাথে একই কাতারে কমপিট করছে, কোন আলাদা ক্যাটাগরিতে না কিন্তু। শুধুমাত্র ফিচার বা কাহিনীচিত্র হিসাবে, ভেনিস-বার্লিন যে একের পর এক নন-ফিকশন ছবিকে শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার দিলো, তার কোনটাই কিন্তু  নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে না, ফিচার বা পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র হিসাবেই। বার্লিনে গোল্ডেন বেয়ার পাওয়া 'টাচ মি নটে'র পরিচালক তো সাক্ষাৎকারে বলেই দিলেন, “We refuse the documentary label with all our force. It’s a hybrid of fiction and reality.”

 

রিবেরু: আমাদের সাধারণ দর্শক কি প্রস্তুত এধরনের হাইব্রিড ছবির জন্য?

সাইমন: দর্শককে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই, তাঁরা ছবি ক্যাটাগরাইজ করেন না। ছবিটা দেখেন স্রেফ ছবি হিসাবেই। 'শুনতে কি পাও!' বা 'নীল মুকুটে'র অভিজ্ঞতা থেকে আমার অন্তত তাই মনে হয়েছে। 'শুনতে কি পাও!' ছবিটির দুর্ভাগ্য, এটি হয়তো সময়ের একটু আগেই বানানো। কিন্তু এটা শিল্প সমালোচকদের মিস করাটা অন্যায়, কারণ তাদের কাজই পুরনোকে নয়া দুনিয়ার সাথে পরিচয় করায় দেওয়া, তাই না? এইবার যখন 'অন্যদিন...' ইডফা'র মূল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হলো, লিডিং একটা ফেস্টিভ্যালের মূল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ছবি কম্পিট করছে প্রথমবারের মতো, লক্ষ্য করলাম এটা অনেক বিনোদন সাংবাদিকও মিস করে গেছেন। অনেকে না দেখেই ধরে নিয়েছেন, এইটা কামারের আরেকটা নন-ফিকশন, যেটা আমাদের প্রচলিত সংজ্ঞায় 'পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র' নয়। অথচ ইডফা যখন কান-বার্লিন-ভেনিসের পাশাপাশি দুনিয়ার প্রথম দশটা উৎসবের লিস্টে স্থান পায়, তখন সেটা ডকুমেন্টারি বা নন-ফিকশন ক্যাটাগরিতে পায় না, তাবৎ দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম দশটার মধ্যেই পায়! এর আগে ২০১৭ সালে 'অন্যদিন...' যে কানের সিনফন্দেশিওনে এক্সক্লুসিভ আমন্ত্রণ পেলো, সেইখানে কিন্তু বাকি সব ছবিই যাকে প্রচলিত সংজ্ঞায় 'ফিকশন' ছবি বলে, সেগুলো ছিলো, বা ২০১৬ সালে লোকার্নোতে ওপেন ডোর্সে শ্রেষ্ঠ পুরষ্কার পেলো, যার জন্য প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোন নির্মাতা হিসাবে আমাকে পিয়াৎজা গ্রান্দায় ফিচারড রেড কার্পেট ডিরেক্টরের সম্মাননা দেওয়া হলো, যেখানে কিনা বেলা তার বা কিরোস্তামির মতো নির্মাতারা সম্মাননা পেয়েছেন, সেইখানেও বাকি সবগুলা স্ক্রিপ্টই কিন্তু আমাদের প্রচলিত সংজ্ঞায় তথাকথিত ফিকশন ছিলো, কিন্তু 'অন্যদিন...' সেরা ফিচার চিত্রনাট্যের পুরস্কার এবং আর্তে ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ পেলো, বাকি সব ফিচারকে পেছনে ফেলেই, আলাদা কোনো ডকুমেন্টারি ক্যাটাগরিতে না, শুধুমাত্র ফিচার সিনেমার স্ক্রিপ্ট হিসাবে!

রিবেরু: ‘মমি’র ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছে, ‘কয়েক বছর ধরে নন-ফিকশনে দুঃসাহসিক, অপ্রত্যাশিত, বুদ্ধিদীপ্ত আর দুর্দান্ত সব কাজ হচ্ছে। এখনকার নন-ফিকশন চলচ্চিত্রকারেরা সিনেমার নতুন ঘরানা সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিশীল। ছবিগুলো দেখতে শুরুতে অসংলগ্ন লাগলেও এগুলোকে তথ্যচিত্র মনে করাটা ডিসেপটিভ বা প্রতারণামূলক হবে।’ ‘মমি’র উৎসবে আপনার ও অন্য ছবিগুলো নিয়ে আপনার কোনো মন্তব্য থাকলে বলুন।

সাইমন: এবার 'অন্যদিন...' যে ‘মমি’র ফেস্টিভ্যালে দেখানো হচ্ছে, সেটা কোনো নন-ফিকশন ফেস্টিভ্যাল না, একেবারে পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র উৎসব, যেখানে মাত্র ১৮টি ফিচার ছবি দেখানো হচ্ছে, যার মধ্যে 'অন্যদিন...' একটা, সবগুলাই কোনো না কোনো বড় উৎসবে প্রতিযোগিতায় ছিলো বা পুরস্কার পেয়েছে। যেমন উদ্বোধনী ছবি 'মুরিনা' ২০২১ সালের কানে ক্যামেরা দ্য'র বিজয়ী ছবি, ক্লোজিং ছবি 'ব্যালকনি' লোকার্নো চলচ্চিত্র উৎসবে গ্রাপ্রি বিজয়ী। এছাড়া 'পেত্রভস ফ্লু' ২০২১-এর কানে পাম দ্য'র দৌঁড়ে ছিলো এবং সিনেমাটোগ্রাফির জন্য পুরস্কৃত হয়েছে, 'মি’। ‘ল্যান্ডবার্গিস' ইডফায় শ্রেষ্ঠ ছবির পুরস্কার পেয়েছে, 'বাবই ইয়ার কনটেক্সট' কানে বিশেষ পুরস্কার পেয়েছে, ‘ফেদার’ কানের ক্রিটিকস উইকে গ্রাপ্রি পেয়েছে। ‘শুনতে কি পাও!’কে যদি নন-ফিকশন বলি, ‘অন্যদিন...’কে বলতে হবে হাইব্রিড ফিকশন ব্লেন্ডেড উইথ রিয়ালিটি, দুটির কোনোটিকে আর যাই হোক, ডকুমেন্টারি বলা যাবে না।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!