• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

প্রবীর সরদারের গানে জড়িয়ে আছে মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জুন ২০, ২০২২, ০৪:৫৬ পিএম
প্রবীর সরদারের গানে জড়িয়ে আছে মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি

প্রবীর সরদার, বাংলাদেশের এক গীতিকবির নাম। ছেলেবেলা থেকেই গ্রামবাংলার সংস্কৃতি-কৃষ্টি-লোকাচারের ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠেছেন যিনি। কখনো ডানপিটে ছেলে তো কখনো শিশুসুলভ বেশ শান্ত। বাংলার দক্ষিণ প্রান্তে বেড়ে ওঠায় প্রাকৃতিক নানান বৈরিতার ভেতর দিয়েও চলতে হয়েছে তাকে। আর সেখান থেকেই অর্জন করেছেন টিকে থাকার জীবনী শক্তি। পেয়েছেন সংগ্রামী এক লড়াকু জীবন। অনুপ্রাণিত হেয়েছেন বাংলার মানুষের জন্য কিছু করতে। সেই অনুপ্রেরণায় হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। রচনা করে গেছেন একের পর এক গণসংগীত। গান নিয়ে খ্যাতির চরমে না পৌঁছে শিকড়ের কথা ছড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি অন্ধকার ও প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়ে যেতে চেয়েছেন গুণী এই গীতিকার। গানের মধ্য দিয়ে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক স্বস্তি দেওয়াই তার কাজ। প্রবীর সরদারের লেখা গান তাই পরম আদরে কণ্ঠে তুলে নিয়েছেন প্রথিতযশা সব শিল্পী। পশ্চিমবঙ্গের শ্রীয়াদা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকান্ত আচার্য, জয়তী চক্রবর্তী, রূপঙ্কর বাগচী, দেব গৌতম, পিউ মুখার্জি, কন্তন ভাচার্য, বিমল দে, সুরভী মুখার্জিসহ আনেকে এই গীতিকারের রচিত গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। সংগীতজীবনের যত গল্প-গান আর আগামীর ভাবনা নিয়ে প্রবীর সরদারের সঙ্গে কথা হয় সংবাদ প্রকাশের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাহনিয়া ইয়াসমিন।

সংবাদ প্রকাশ: আপনার বাল্যকাল এবং লেখাপড়া সম্পর্কে কিছু বলবেন এবং একজন গীতিকার হয়ে ওঠার প্রথম দিকের গল্পটা কেমন ছিল?

প্রবীর সরদার: আমার জন্ম ১৯ আগস্ট ১৯৬৬ সালে সাতক্ষীরা জেলার কালীগঞ্জ থানার বিষ্ণুপুর গ্রামের একটি সাংস্কৃতিক পরিবারে। ১৯৮২ সালে গ্রাম থেকে এসএসসি পাস করার পর খুলনা শহরে আসি এবং সাহিত্যচর্চা শুরু। কমার্স কলেজে পড়াকালে দেয়ালপত্রিকা বা বার্ষিক যে পত্রিকাগুলো থাকে, সেখানে নিয়মিত লিখতাম। তারপর খুলনায় পূর্বাঞ্চল, জন্মভূমি এসব সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত আমার কবিতা ছাপা হতো। পাশাপাশি শুরু করি রেডিও প্রোগ্রাম। কবিতা-গল্প লেখার পাশাপাশি জড়িয়ে পড়ি প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনে। সুস্থ সংস্কৃতিচর্চা এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে যুক্ত হই পতন অবধি। এই কালচারাল অ্যাক্টিভিটসের সঙ্গে এসেই আমার গানের প্রতি আলাদা একটা আকর্ষণ জন্মে। আমি তখন দেখতাম সংগঠনের ছাত্ররা দারুণ গান করে, আবৃত্তি করে, লেখালেখি করে। তারপর আমিও গান লেখা শুরু করলাম। ১৯৮৩-তে আমি ‘বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী’-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। দেখলাম সেখানে নতুন নতুন গান লেখা হচ্ছে, সুর করা হচ্ছে। আমিও অনুপ্রাণিত হলাম। এর পর থেকেই মোটামুটি আমার গানের পথচলা শুরু হলো। 

সংবাদ প্রকাশ: গান লেখার পাশাপাশি সুর করা নিয়ে ভাবছেন কি না?

প্রবীর সরদার: আমি গানের সুর করতে পারি না। সুর করার বিষয়টা আমি ভালো জানি না। যারা ভালো সুর করেন, তাদের সঙ্গে আমার সখ্যতা আছে, ভালো পরিচয় আছে। আমি গান লিখে তাদের দিয়েছি। আমার গানের কথা-ছন্দ-অন্ত্যমিল তাদের পছন্দ হলে তারা সুর করেছে। এমনও হয়েছে, আজ গান লিখলাম, সন্ধ্যায় রিহার্সাল হলো, কাল গাওয়া হলো। এই স্পন্টনিয়াস চলার বিষয়টা আমাকে উৎসাহিত করছে সব সময়। 

সংবাদ প্রকাশ: আপনার লেখা উল্লেখযোগ্য কোনো গানের কথা এই মুহূর্তে বলতে পারবেন?

প্রবীর সরদার: এটা খুব কঠিন প্রশ্ন, তবে যশোর হত্যাকাণ্ডের ‘গোধূলিলগ্ন’ গানটি আমার কাছে খুব হৃদয়স্পর্শী। এই গানটা আমার ভীষণ প্রিয় একটা গান। আর ‘বেদনা’ শিরোনামে একটা গান আছে, যার সুর করেছে তুহিন দত্ত। গানটি আমাকে খুব বেশি স্মৃতিকাতর করে তোলে। 

সংবাদ প্রকাশ: নিজের লেখা গানে কণ্ঠ দেওয়ার কথা ভেবেছেন কখনো?

প্রবীর সরদার: না না, আমি নাটকের মানুষ। আমি নাটক লিখি, নাটকের সঙ্গে কাজ করি। গানটা আমি গাইতে পারি না। ওটা আমার দখলে নেই। আমি গান শুনতে ভালোবাসি। আর গুনগুন করে গাই মাঝেমধ্যে। তবে সেটা সবার সামনে কখনো না। 

সংবাদ প্রকাশ: কোন ঘরানার গান লিখতে বেশি পছন্দ করেন?

প্রবীর সরদার: আমি মূলত গণসংগীত লিখতে পছন্দ করি। মানুষের জন্য গান লিখতে পছন্দ করি। আমার গানের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কথা বলতে চাই। উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনদার একটা বাণী আমার কাছে দর্শন মনে হয়। “মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী, তাই দিয়ে রচি গান, মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব মানুষের দেওয়া প্রাণ”। বাবা-মায়ের কাছ থেকে যে প্রাণ আমি পেয়েছি, তা মানুষের কল্যাণে দিয়ে যাব। তবে তার পাশাপাশি আধুনিক, পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া গান লেখা হয়। 

সংবাদ প্রকাশ: আপনার লেখা গান কম্পোজিশন বা রেকর্ডের সময় আপনি কখনো উপস্থিত ছিলেন কী?

প্রবীর সরদার: হ্যাঁ, আমি উপস্থিত ছিলাম।

সংবাদ প্রকাশ: কেমন ছিল সেই অনুভূতি? 

প্রবীর সরদার: আমার গান যখন বাইরের লোকের মুখে শুনি, সেটা রেডিওতে হোক কিংবা মঞ্চে কিংবা মাইকে, সেটা খুব ভালো লাগে। কারণ, গানটা যখন কারও কণ্ঠে ভেসে ওঠে, তখন গানটি তার প্রাণ ফিরে পায়। তাই আমার গানগুলো যখন আমি শুনি, সে অনুভূতি সত্যিই অপূর্ব থাকে। 

সংবাদ প্রকাশ: গান চুরির ঘটনা ইদানীং আমাদের দেশে অহরহ ঘটছে। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?

প্রবীর সরদার: কপিরাইটের প্রবণতাটা এখন অনেকে বেশি। অনেকে চিত্রকল্পটাকে চুরি করে, কেউ শব্দ চুরি করে, কেউ থিম চুরি করে, কেউ একটা লাইনই চুরি করে নেয়। আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী। ১৯৯৬-৯৭ সালে আমার একটা গণসংগীত চুরি হয়ে গিয়েছিল। এক ব্যক্তি পত্রিকায় লিখেছেন গানটা তারই গান এবং তারই সুর করা। তারপরে অবশ্য সে স্বীকার করেছে এ জন্য আমি কোনো হেনস্তার মধ্যে নিয়ে যায়নি তাকে। আমি এখন এই বিষয়টিতে খুব সচেতন। তবু দেখি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমার নাম ছাড়া আমার গানের কোড করা হয়। সে ক্ষেত্রে যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়, তাহলে আমার কোনো আপত্তি থাকে না।

সংবাদ প্রকাশ: আপনার লেখা জনপ্রিয় গানসহ অন্যান্য গানগুলো কি কপিরাইট করা হয়েছে?

প্রবীর সরদার: জি, সম্প্রতি আমি আমার গানের কপিরাইট করেছি। ২০২১-এর অক্টোবরের দিকে আমার গানের কপিরাইট করা হয়েছে। এর আগেরগুলো করা নেই। আরও কিছু বাকি আছে, যেগুলো কপিরাইট করানো হবে। 

সংবাদ প্রকাশ: বর্তমান সময়ের গানগুলো বাজারে আসার কিছুদিন পরই হারিয়ে যাচ্ছে কেন?

প্রবীর সরদার: সত্য বলতে কি, সব গান হারিয়ে যায় না। জনপ্রিয়তার জন্য চটুল ধাঁচের গান করলে তা সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। তা ছাড়া গান মৌলিক একটা বিষয় হলেও তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায় সুর এবং গায়কির মধ্য দিয়ে। এই গায়কি এবং সুর ভালো না হলে গান যতই ভালো লেখা হোক না কেন, সে গান ভালো গান হিসেবে সমাদৃত হবে না। গান একটা প্রতিমার মতো। খড়ি দিয়ে মাটি দিয়ে তাকে বানানো হয়। কিন্তু যেদিন চক্ষুদান করা হয়, সেদিন প্রতিমা প্রতিষ্ঠা পায়। আমারও প্রতিষ্ঠা পায় তখনই, যখন সুর এবং গায়কি ভালো হয়। অনেকে আমার গানের প্রশংসা করেছে। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাদের। আমার গানে আমি চেষ্টা করেছি চটুল বা গতানুগতিক কিছু না দিতে। আমার গানে থাকবে একটু মনস্তত্ত্ব, একটু স্বস্তি। গান শুনে একটু মেধা খাটাতে হবে শ্রোতাদের। 

সংবাদ প্রকাশ: প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে মেধা ও কণ্ঠ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর গান নিয়ে তেমন কাউকে সাধনা করতে দেখা যায় না—বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

প্রবীর সরদার: আমি কয়েকটি দেশের সঙ্গে কাজ করেছি। তবে পাশের দেশে ভারতের সঙ্গেই আমার বেশি কাজ করা হয়েছে। আমাদের দেশ রাতারাতি শিল্পী হতে চায় গায়কেরা। আমি বেশি কিছু বলব না, যেহেতু গানের মানুষ আমি না, গান লিখি বটে কিন্তু গান করি না। এখানে গায়কদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তারা শিখে গান করবেন নাকি শেখার আগেই স্টার বনে যাবেন। সাধনার কথা যদি বলেন, এখনো সাধনা করেন শিল্পীরা। আমি দেখেছি ভারতে আমার একটি গান গাওয়ার জন্য শিল্পীরা কখনো তিন মাস, কখনো দুই মাস সময় নিয়েছেন। কারণ, গানটা আগে তিনি রপ্ত করবেন তারপর গাইবেন। এবং এই যে সময়টা নিচ্ছেন, এখানে পুরো সময়টা কিন্তু আমার ওই একটি গানের পেছনে দিচ্ছেন। কাজেই গানের প্রতি এই সাধনার কারণেই কিন্তু গান ভালো হচ্ছে। 

সংবাদ প্রকাশ: কণ্ঠশিল্পীরা টিভিতে, স্টেজে সংগীত পরিবেশন করে আসছেন। এ আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন গীতিকার, সুরকার। এখান থেকে কি গীতিকার, সুরকার ভাগ পেতে পারেন?

প্রবীর সরদার: অবশ্যই ভাগ পাওয়া উচিত। কিন্তু ভাগ তো দূরের কথা, এখন তো বলাও হয় না গানের গীতিকার কে, সুরকার কে। আমার তো মনে হয় যন্ত্রী যারা বাজায়, তাদেরও নামও বলা উচিত। কারণ, এগুলো তো তাদেরই সৃষ্টি। কাজেই এটি গান তৈরির পেছনে সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। এবং এই যে সম্মানীটুকু প্রত্যেকের পাওয়া উচিত। শুধু গীতিকার-সুরকার নয়, আমি দাবি করব বাদ্যযন্ত্রীও যেন সম্মানীর একটা অংশ পান।

সংবাদ প্রকাশ: জনপ্রিয় কবিতা বা গান থেকে দুটি লাইন নিয়ে নতুন করে গান তৈরি হচ্ছে। এটা করার সুযোগ আছে?

প্রবীর সরদার: গানে বৈচিত্র্য আসতে পারে। কে কীভাবে প্রয়োগ করবেন, এটা তাদের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। অনেক কবিতা থেকেই গান এসেছে। এটা হতে পারে। কিন্তু গানের যে ছকটা আছে, যে গ্রামার আছে, সেটা যদি মেনে করা হয়, তাহলে ঠিক আছে। জোর করে কবিতাকে গানে রূপান্তরিত করার পক্ষপাতী আমি নই।

সংবাদ প্রকাশ: অনেকেই গীতিকারদের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে চান না। আপনার দৃষ্টিতে কবিসত্তা এবং গীতিকার সত্তার মধ্যে কোনো সাংঘর্ষিক ব্যাপার আছে কি?

প্রবীর সরদার: বিষয়টা সৃজনশীলতার ব্যাপার। যিনি কবিতা লেখেন, তাকে কবি বলা ভালো। আবার যিনি কবিতার ঢঙে গান লেখেন, তাকে ‘গীতিকবি‘ বলা ভালো। আমি গীতিকবির পক্ষে। 

সংবাদ প্রকাশ: গান লেখা নিয়ে কোনো মজার ঘটনা বলবেন কি?

প্রবীর সরদার: গান লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো এটা, যখন যেটা ভেবে লিখতে যাই, সব সময় সেটা হয় না। একটা কথা বলা হয়ে থাকে, ‘শিব গড়তে গিয়ে বাঁদর হয়ে যায়। আবার বাঁদর ভাবতে ভাবতে কখনো শিব হয়ে যায়।’ অর্থাৎ অন্যদিকে টার্ন নেয়। কাজেই এই বিষয়টা আমার বেশ মজাই লাগে। 

সংবাদ প্রকাশ: একজন গীতিকার হিসেবে আপনার প্রথম প্রাপ্তির অনুভূতি কেমন ছিল?

প্রবীর সরদার: স্বাধীনতার ৫০ বছরে বা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আমার একটা গান ছিল। টেলিভিশনের ১০০টা গানের মধ্যে আমার একটা গান স্থান করে নেয়। সেই গানটাই কোনো এক জেলায় গাওয়া হয়েছে এবং আমাকে জানানো হয়েছে। তো আমার গানের এই ব্যাপ্তি এবং প্রসারই আমার কাছে বড় প্রাপ্তি। খুব ভালো লাগার একটা অনুভূতি।

সংবাদ প্রকাশ: বর্তমান সময়ে গানকেন্দ্রিক আপনার ব্যস্ততা সম্পর্কে জানতে চাই।

প্রবীর সরদার: আমাকে গান লিখতে হয়। সেটা সব সময় প্রচারের জন্য, বিষয়টি কিন্তু তা নয়। গান তো জোর করে লেখা যায় না। গানটা আসলে আসে। গান তো ক্ষুধা। তো গানের এই ক্ষুধা লাগলেই আমাকে গান লিখতে হয়। তা ছাড়া কারও জন্য যদি লিখি, তাহলে তার দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে তাকে নির্দিষ্ট গানটি সরবরাহ করি।

সংবাদ প্রকাশ: আপনাকে ধন্যবাদ।

প্রবীর সরদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।

কথাপ্রকাশ বিভাগের আরো খবর

Link copied!