• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫

শ্রী ভৃগু জ্যোতিষালয়


রাজীব কুমার দাশ
প্রকাশিত: আগস্ট ২৮, ২০২২, ০৭:১৭ পিএম
শ্রী ভৃগু জ্যোতিষালয়

আমার ক্লাসমেট জ্যোতিষী চন্দ্রাবতী পুলোমা ভৃগু চাকরি-বাকরি না খুঁজে বাবার পেশা বেছে নিয়েছেন। বর্তমানে ঢাকা শহরের ঘিঞ্জি শাঁখারিবাজারে শোভা জুয়েলারির পাশে ‘শ্রী ভৃগু জ্যোতিষালয়’ নামে যে জ্যোতিষ প্রতিষ্ঠান আপনারা দেখতে পান, তা আগে তার বাবা হরিহর ভৃগু দেখভাল করতেন। জ্যোতিষালয় কিন্তু যেনতেন প্রকারের জীবনমুখী পণ্য, নিত্যকার অসুখ বিসুখের কবিরাজি হোমিও এলোপ্যাথিক দোকান না। এই পেশার মানুষের হতে হয়, ধন্বন্তরি কৌশলী অনেক জ্ঞানী। জানতে হয়, কর্ণপিশাচ সাধনা। রোজগেরে গিন্নির হাতের বানানো পায়েস মোয়া চেটেপুটে খেতে পারার স্তাবক কৌশল। হাড়কিপটে আবালবৃদ্ধ হয়ে উকিল-পুলিশ-চিকিৎসক-বিচারক, নেতা, বিসিএস, সাংবাদিক সুশীলের চোখ মুখ দেখে দেখে নবগ্রহ কবচ রত্নপাথর বিক্রি করেন। আপনারা কেউ যদি শাঁখারিবাজার যান, ভৃগু জ্যোতিষালয় দেখতে পাবেন। দেখতে পারবেন, মাঝবয়সী রাশভারী বনেদী ঘরানা কপালে বড় লালটিপ পরা, দুহাতে মোটা সোনার বালা, গলায় সীতাহার, চোখে সৌখিন চশমা পরে  চরম হতাশাগ্রস্থ ‘আমি বাঁচতে চাই’ টাইপের বীতশ্রদ্ধ জীবনের মানুষগুলোকে, ‘আপনিই তো সবকিছু পারবেন, আপনাকে পরিবারের জন্যে বেঁচে থাকতে হবে, ভাগ্য সুপ্রসন্ন, পৃথিবী আপনাকে চায়।’

চন্দ্রাবতী ভৃগু এই রকমের হাজার আশার প্রেরণা কবচ, রত্নপাথরে বাঁচার আশা দিয়ে পৈত্রিক রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। চন্দ্রাবতী পুলোমা ভৃগু ওর বাবার একমাত্র সন্তান। ওর বাবার মতে, বেকার জীবনের আগে একটিই নীতিকথা, ‘পুঁথিগতবিদ্যা পরহস্তে ধন, নহে বিদ্যা নহে ধন হলে প্রয়োজন।’ যদি কেউ তা মেনে চলেন, তাকে কোনোদিন কারোরই  মুখাপেক্ষী হতে হবে না। চন্দ্রাবতীর বাবা ঠিকই তো বলছেন। নীতি বাক্যের চোখে হালের জাজ্বল্যমান উদাহরণ আমি স্বয়ং! চন্দ্রাবতী পুলোমা ভৃগু আমার সামনে মানুষের হাত দেখে ঘণ্টাখানেক সময়ে যা
কামাই করেন, আমার মতিঝিলপাড়া-গুলশান-বারিধারা হয়ে নানা জীবনধারা সয়ে ছোট চাকরি-বাকরি করে পুরো মাসে আয় করা সম্ভব না। চন্দ্রাবতী অবশ্য আমার দুর্দশা বুঝতে পেরে হাত দেখে ফ্রি পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, ছোটখাটো ব্যবসা চালিয়ে যাও, থিতু হতে পারবে। চন্দ্রাবতীর পরামর্শ মেনে থিতু হতে মা’র শখের বালা বিক্রি করিয়ে ফকিরাপুল মতিঝিল মোড়ে পঞ্চপাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস মনে খোলা ভ্যানে বঙ্গমার্কেট গুলিস্তান হতে সস্তা দরে প্যান্ট-গেঞ্জি-মোজা টি-শার্ট এনে বিক্রি করতে লাগলাম। দাম সর্বোচ্চ  একশ একশ। বঙ্গমার্কেট গুলিস্তান মার্কেট হতে বেছে বেছে পুরাতন কাপড় নতুন মোড়কে প্যাকেট করা, ছেঁড়া পড়লে রিপু করা, দিন সপ্তাহ মাসের লাইন খরচ  চালিয়ে হেলপার খরচ, দৈনিক ভ্যানভাড়া মিটিয়ে  ফকিরাপুল ঘুপচি হোটেলের রুম ভাড়া চুকিয়ে রাস্তার পাশে কমদামী হোটেলে খেয়েও থিতু হতে পারছিলাম না।

বাড়ি হতে জানিয়ে দেয়া হলো, ‘তোমাকে দিয়ে আর তেমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। তোমাকে বরং শেষবারের মতো একটা সুযোগ দিতে পারি, ‘তুমি সৌদি আরব-দুবাই চলে যাও।
ওখানে উট-দুম্বা চড়িয়ে পুষে কিছু একটা করার চেষ্টা চালিয়ে যাও।’

মাথা মোটা মানুষ আমি! চাঁদকে চাঁদ  দিনকে দিন, রাতকে রাতই দেখি। দুয়ে দুয়ে চার, চারে তিন যোগে সাতই দেখি। হাইস্কুলে বিজ্ঞানের  ডালিম স্যার, চন্দ্রাবতী ভৃগুর দিকে অপাঙ্গদৃষ্টিতে তাকাতেন। পড়াবার ফাঁকে কিছু লিখতে দিতেন। স্যার ভৃগুর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতেন। অতশত না বুঝে ভাবতাম,আহা! স্যার কতোটা বিনয়ী। হেসে হেসে চন্দ্রাবতী ভৃগুকে অঙ্ক শিখিয়ে দেন। চন্দ্রাবতী ক্লাসের সেরা সুন্দরী বলে সহসা অন্য স্যারেরও দৃষ্টি নিবন্ধিত করে রাখতে পারতেন।

একদিন স্যারকে খুশীর জোয়ারে বললাম, ‘স্যার,আপনি চন্দ্রাবতীর মতন আমাকেও
চোখে চোখে শিখিয়ে দেন। দেখবেন, আমিও অনেক অনেক ভালো কিছু করব।’

ক্লাসভরতি  ছাত্রছাত্রী কেউ হো হো  হা হা করে, কেউবা মুচকি হেসে ডালিম স্যারের চোখেমুখে ভীমরুলের বাসা ছুঁড়ে দিলেন। স্যারের চোখেমুখে রাজা পৃথ্বিরাজের হাতে মুহাম্মদ ঘোরির প্রথম পরাজয় দ্রোহের প্রতিশোধ আগুন ধিকিধিকি করছে দেখে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। রাগ সংবরণ করে ছাত্রীদের কমন রুমে পাঠিয়ে দিলেন।

স্কুল শেষে আমি ভৃগুকে জিজ্ঞেস করলাম:
—চন্দ্রাবতী
—বলো।
—আচ্ছা, ডালিম স্যার মুচকি মুচকি হেসে চোখগুলো কেমন গুলিয়ে গুলিয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে কেন?
—গাধা! ওসব তুমি বুঝবে না।
—তাহলে?
—আরে অঙ্ক শেখায়! অঙ্ক! এবার বুঝলি? গাধা কোথাকার। এগুলো চোখের ভাষা। মানুষ শুধু মুখের ভাষা দিয়ে সবকিছু ঠিকমত শিখতে পারে না। মানুষের চোখ-কান-মুখ-জিহ্বা এমনকী, শরীরের সুক্ষ্ম স্থূল চামড়া মাংসল স্নায়ুর ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকে শরীরী-অশরীরী ভাষা।

ঠিকই তো! চন্দ্রাবতী বলেছে। তখন আনাড়ি ছিলাম বলে চন্দ্রাবতী চোখে কিছু খুঁজে পাইনি। বুঝতে পারিনি, চন্দ্রাবতী চোখে আবেগের ঘূর্ণিঝড়, কামনার ভিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরি। ভরা যৌবনেও ক্ষুধা তৃষ্ণা বিরহ দহন। দেহ মনের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে ফোটা অব্যক্ত কষ্টের ফণিমনসা ফুল। নারীরা আগে পারে। পুরুষেরা পরে।  নারীরা পুরুষের আগেই সবকিছু কড়ায়গণ্ডায় বুঝে নেয়। দ্রোহের আগুনে ছিনিয়ে নিতে জানে সুখ ঐশ্বর্য বিলাস। ছলনা মনে পুরুষের  সকল অর্জিত অর্জন কেড়ে ন্যাংটা করে ছেড়ে দিতে জানে।

মানুষ দিনলিপি মনে প্রতিদিন অনেক ভাষা শিখে নেয়। পেশার ভাষা, নেশার ভাষা, কামনার ভাষা,ঘৃণা দ্রোহ বেদনা। এমনকী যৌনতার দরদাম করতে গিয়েও নতুন নতুন ভাষা শিখে। তাই তো ঘরে বাইরে হোটেল কটেজ পানশালা সমুদ্রতীরে পুরুষকে চরম বেহায়া কাতর সুরে স্বরে নাতনি বয়সী কিশোরির অভিমান ভাঙাতে বলতে শোনা যায় : ‘তুমি আমার জানু পাখি, সাত আসমানের তারা, তুমি ছাড়া এই জীবন চরম সর্বহারা।’

তারপর কিশোরীটি  নাম ধরে ডাকে। রঙিলা গর্দভ ডেকে ভাইয়া দাদু প্রেমিক কাছে টেনে নেয়। কানমলা দেয়। কান ধরে উঠবস করায়। পা টেপাতে থাকে। সবশেষে ভাইয়া দাদু প্রেমিক কিশোরীর সকল শর্ত মিটিয়ে প্রজাপতি মনে নারী যৌবন অগ্নিকুণ্ডে জ্বলে পুড়ে ছাই ভস্ম মেখে চিরতরে হারিয়ে যায়।

যৌবনের চোস্ত ভাষা কারোরই কাছে ক্ষতিকর না হলেও  পুলিশের ভাষা, উকিলের ভাষা, আইনের ব্যাখ্যা নজির আদালতের ভাষা, বিচারক মনে সাংবিধানিক শপথের সাংঘাতিক সাংঘর্ষিক ভাষা, কুটিল ধূর্ত ড্রাইভার মজদুরের ভাষা, ব্যবসায়ী মনের ভাষা, রাজনৈতিক ভাষা, নির্বোধ লেখক দুর্বোধ্য স্ত্রৈণ কবির ভাষা এই সময়ে এসেও কেমন জানি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। চিনতে পারি না এ সময়ের ডালিম স্যার, স্যারের শিষ্যদের!

পরের দিন যথারীতি ক্লাসে এসে স্যার, সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমিও স্যারের চোখে মুখে তাকিয়ে মনে করেছি, ‘এই বুঝি স্যার কৃপা করবেন। কৃপাসিন্ধু সেজে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এইমাত্র বুঝি সাক্ষাত ডালিম স্যারের চোখে বিশ্বরূপ দেখাতে অবতীর্ণ হবেন। আমাকে জ্ঞানমার্গের চৈতন্যচরিতামৃত গুহ্যজ্ঞান দান করবেন!’

ডালিম স্যারের চোখেমুখে সাক্ষাৎ ভগবানের অহৈতুকী করুণা কৃপা দেখে আমি প্রেম ভক্তিরসে গদগদ কণ্ঠে বললাম : ‘স্যার, আপনি মহান। আপনি চন্দ্রাবতী চোখে যে প্রকারে জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে ঋদ্ধ করেছেন, আমাকেও সে প্রকারে জ্বালিয়ে দিন প্রভু!’

সমস্বরে ক্লাস বন্ধুদের হা হা হো হো শুনতে পেয়ে হতচকিত হলাম। স্যারের হাতে কংসের গদা দেখে দৈববিড়ম্বিত মনে ভয়ে পালিয়ে যেতে চাইলাম। তারপরে কী হয়েছে আমার মনে নেই। আমি সেই হতে এই, ঘরে বাইরে ফুটপাত পেরিয়ে আদালত ছাপাখানা বদ্যিখানা হয়ে জ্যোতিষালয়ে পৌঁছে ধূর্ত বিনয় ধূর্ত সততা বহুরূপী চর্যাপদ সংবিধানের ভাষা খুঁজে চলেছি এখন।

Link copied!