• ঢাকা
  • বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

নির্বোধ জীবন


রাজীব কুমার দাশ
প্রকাশিত: জুন ১১, ২০২২, ০৫:৩৬ পিএম
নির্বোধ জীবন

‘ছন্দহীন নূপুরের তৃপ্তিহীন
ঝংকার ইথারে ভেসে বেড়ায়
চাল চুলোহীন নির্বোধ জীবনটা
সত্যিই কি চটিগল্পময়!’

চরম আক্ষেপ নিয়ে জীবননগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কালাম স্ট্যান্ড রিলিজ হতে সবেমাত্র ধূসর মুখবদ্ধ খামটি হাতে পেলেন।
সামনে বসে আছেন চেনা-অচেনা সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, হেডমাস্টার, প্রফেসর। ওরা বসে আমুদে লাল চা গিলে জর্দা পান মুখে সিগারেট টানছে।

সযতনে খাম খুলে ওসির চেহারায় ভেসে এলো হতাশার টর্নেডো ঝড়। এ কী! ঠিক আগের মতো! তল্পিতল্পা গুছিয়ে নিতে হবে এখন। সামনে বসা সুধীমহল ওসির নিয়তি বনের খাণ্ডবদাহন দেখবেন; তা আগেই আঁচ করে এতক্ষণ সামনে বসে মিছেমিছি স্তুতি গাইছিলেন। এদিকে নতুন ইন্সপেক্টর জয়েন করে থানার দায়িত্ব নিতে বুভুক্ষু কাঙালের মতো ‘ভাতে কাঁকড় দেখার সময় নাই’ হাপিত্যেশ মনে পায়চারি করে চলেছেন।

নতুন অফিসারের নাম চিনুক আলী মণ্ডল, বিপিএম, পিপিএম (বার)। অলখ হাসিতে রাজা রাজা ভাব। দুটি চোখে ধড়িবাজ শ্যেন দৃষ্টি। নেই গোঁফদাড়ি, দুটি হাতে দলিত-মথিত রেখা, অধূমপায়ী। সাদা ক্রিমের কৃত্রিম লাল ঠোঁটগুলো চুমো ভঙ্গিমা ঢং করে হাসার চেষ্টা করেন। দেখতে অবিকল দীর্ঘস্থায়ী সঙ্গমের পরে ফোলা শারমেয়ী যোনি।

বারবিলাসিনী ভণিতা নারীর মতো, জীবন মানে যন্ত্রণার ভাব নিয়ে এক এক করে থানা অফিসার, সাংবাদিক, রাজনৈতিক বড় নেতা, পাতি নেতা, খুচরা ভাঙতি নেতা, সুশীল বড় ভাই, বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিল্পী সমাজের সঙ্গে প্রাথমিক পরিচয় পর্ব সেরে নিলেন।

সরকারি অফিসের পিয়ন, পুলিশের আরদালি ড্রাইভার, আরও, আরআই, মুন্সীকে হতে হয় খাঁটি স্তাবক বেশ্যা ও ধড়িবাজ। ভণ্ড জ্যোতিষী ফুটপাত কবিরাজ হাড়কিপটে আমজনতার বাজার সদাই টাকা যে প্রকারে হাতিয়ে নেন; সে প্রকারে তারাও Is the morning show coming back? সরীসৃপ গিরগিটি মনে আগাম বার্তা বুঝে নিতে পারেন। সুযোগ বুঝে লুফে নেন সময়ের নিরবচ্ছিন্ন সুযোগ প্রহসন। স্তাবক ডক্টরাল গবেষণা করে হাতিয়ে নেন; কাঙ্ক্ষিত সুযোগ-সুবিধা।

এখন খাবার পর্ব শুরু হবে। আবুল কালাম সাহেব এখন পুলিশের খাতায় ‘ডেথ হর্স’। জেনারেল ডায়েরি প্রস্থানে কিছু সময় পরে প্রাক্তন। ফেসবুক, সিনিয়র-জুনিয়র অফিসার, ধান্ধাবাজ পাবলিকের ‘congratulations’ আপনি পুলিশ বিভাগের অহংকার স্তাবক খাটে ক্লান্ত পুষ্টিহীন যৌনকর্মী মনে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
সহজ-সরল ‘প্রাক্তন’ মনে বেশ কষ্ট নিয়ে বিদায়ের ভেলা ভাসাতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। অনাড়ম্বর বিদায়বেলায় নেই ছোট ছোট ভালোবাসা স্তুতি। চারিদিকে চলছে নতুন বরণের হুলুস্থুল।

প্রাক্তন কালাম সাহেব নতুনের সামনে বসে আছেন। নতুনের গুরুগম্ভীর গুরুভাব চোস্তভাব দেখে মনের অজান্তে চিন্তার রাজ্যে সময়ের নিরস্ত্র মেঘনাদ হয়ে বিশ্বাসঘাতক বিভীষণকে ভর্ৎসনা করে চলেছেন।

থানার সব রেজিস্টার, অস্ত্রাগার, ক্যাশ, তদন্ত ব্যয় রেজিস্টার, সরকারি সম্পত্তি, বেসরকারি জমা রাখা অস্ত্র নতুনকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। মনটাকে কেন জানি বোঝানো যাচ্ছে না! প্রাক্তনদের জীবনে; নেমে আসে রাজ্যের যত হতাশা, অনিয়মই যেখানে দেশসেরা ‘সততা পুরস্কার’।

—হঠাৎ মাঝবয়সী সময়ের দর্পণ পত্রিকার সম্পাদকের আগমন।
—ভাই, আমার কেসটা ফাইল করেন।
আরে ভাইজান, কেমন আছেন? আমার বদলি হয়েছে, পুলিশ লাইনসে।

ভাই কী যে বলেন! আপনি একজন সৎ...!
ব্যাঙের জিহ্বার মতো খপ করে সাংবাদিক সাহেবের কথাগুলো নতুন ওসি টেনে গিলে নিলেন।

—ভাই, আমি আজকেই জয়েন করেছি, উনি এখন প্রাক্তন, কিছু সময় পরে চলে যাবেন।’

বলুন, কী করতে পারি?
—আমার সংসারে তিন ছেলেমেয়ে; এক যুগের সংসার। আমার বউ রাগ করে জানান; সন্তানের বাবা নাকি আমি না!
তাহলে বলুন কে?
—ওর প্রাক্তন।
ধুর! কী যে বলেন না? তা কী করে হয়!

হয়, হয় ভাই, এখন সবই হয়।

তাহলে আপনিই বলুন, কী করে সম্ভব?

—আমি বোকা সর্বস্বান্ত অতিচালাক কাক মানব, আমার আর হারানোর কিছু নেই।

—ওসি সাহেব 
প্লিজ! বলুন।
‘আমাদের নির্বোধ জীবনটা সত্যিই কি চটিগল্পময়!’


লেখক : প্রাবন্ধিক ও কবি

Link copied!