• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শাবি শিক্ষার্থীরা


সিলেট প্রতিনিধি
প্রকাশিত: জানুয়ারি ২০, ২০২২, ০৮:৪৭ পিএম
আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শাবি শিক্ষার্থীরা

সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ দাবিতে আমরণ অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তীব্র শীতের মধ্যেও আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দিন-রাত কাটছে ভিসির বাসভবনের সামনে। অনশনে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার (২০ জানুয়ারি) রাত ৮টা পর্যন্ত অনশনকারী ৫ শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। অসুস্থ হওয়াদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানা গেছে।

অনশনে থাকা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসুস্থ হওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকায় সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টিম গতকাল অনশনস্থলে উপস্থিত হয়েছে। এ সময় কয়েকজনের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাদের স্যালাইন ও ওষুধ দিয়ে রাখা হয়েছে।

এর আগে উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ২৪ জন বুধবার দুপুর থেকে ভিসির বাসভবনের সামনে আমরণ অনশন শুরু করেন। তীব্র শীত আর অনাহারে বুধবার রাতেই অনশনকারী শিক্ষার্থীদের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। এরপর রাতভর রাস্তায় থাকায় বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তাদের শরীর আরও খারাপ হতে থাকে।

বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থী উমর ফারুক বলেন, আমাদের ২৪ জন ভাই-বোন অনশনে আছে। দাবি আদায়ে এই ২৪ জন যদি মারা যায়, আরও ২৪ জন অনশনে বসবে। এভাবে মরতে মরতে ভিসির বাসভবনের ফটকের সামনের স্থানে একটি মৃত্যুক্ষেত্র তৈরি হবে। তবুও আমরা আমাদের দাবিতে অনড় থাকব।

এদিকে, বুধবার রাতের মতোই বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীদের কাছে কোষাধ্যাক্ষ নেতৃত্বে দফায় দফায় শিক্ষকদের প্রতিনিধি দল যান আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যস্ততা করার জন্য। এ সময় শিক্ষার্থীরা তাদেরকে বলেন, আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলে আপনারা কথা বলতে পারবেন। অন্যথায় আমরা আপনাদের কোনো কথায় কর্ণপাত করবো না।

অনশনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসুস্থ হওয়ার সংখ্যা বাড়তে থাকায় অনশনস্থলে অবস্থান করছে একটি মেডিকেল টিম। বৃহস্পতিবার বিকেলে অনশনরত শিক্ষার্থীদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে মেডিকেল টিমের সদস্য মো. নাজমুল হাসান বলেন, এখানে অনশনরত শিক্ষার্থীদের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। দুইজন শিক্ষার্থীর অবস্থা গুরুতর। এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করছি। গত চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময় কেউ কিছুই খায়নি। সবাই পানি স্বল্পতায় ভুগছে।

তিনি আরও বলেন, যাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে তাদের জন্য স্যালাইনসহ ওষুধের ব্যবস্থা করেছি। আর যদি কোনো জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হয় তাহলে তাদের জন্য অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া তাদের জন্য ওসমানী মেডিকেল কলেজে বেডের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।

এদিকে, শাবি ভিসির উপচার্যের দাবিতে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ ও মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাছাড়া শাবিপ্রবির সাবেক শিক্ষার্থীরাও আমরণ অনশনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সংহতি জানিয়েছেন।

অন্যদিকে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ছাত্রীদের নিয়ে শাবি ভিসির আপত্তিকর মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছে জাবি শিক্ষক সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ। একই সঙ্গে ক্ষোভও জানিয়েছেন শিক্ষকরা। বৃহস্পতিবার সংগঠন দুটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত পৃথক বিজ্ঞপ্তিতে এই প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানানো হয়।

শিক্ষক সমিতির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তা অত্যন্ত অবমাননাকর ও অসম্মানজনক।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও উল্লেখ করা হয়, শাবি উপাচার্যের আপত্তিকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছি। আমরা আশা করি, তিনি প্রকাশ্যে তার ভুল স্বীকার করে অশোভন মন্তব্য প্রত্যাহার করবেন।

এদিকে, আলোচনার প্রস্তাব নিয়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. আনোয়ারুল ইসলাম অসুস্থ হয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। তবে শিক্ষার্থীরা এই প্রস্তাবেও সম্মত হননি।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন বৃহস্পতিবার অষ্টম দিনে গড়িয়েছে। প্রভোস্টের পদত্যাগসহ তিন দফার আন্দোলনের একপর্যায়ে অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে উপাচার্যকে উদ্ধার করতে পুলিশি হামলার পর তিন দফা থেকে এক দফায় উঠে এসেছে আন্দোলন। এখন শিক্ষার্থীদের একটাই দাবি, ‘বিতর্কিত’ উপাচার্যকে তারা শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আর কখনো দেখতে চান না। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাথে দফায় দফায় আলোচনা চেষ্টা করলেও প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছেন। বুধবার রাতে সাড়ে ১১টার দিকেও কোষাধ্যক্ষের নেতৃত্বে শিক্ষকদের প্রতিনিধি দল কথা বলতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তা প্রত্যাখান করেন।

বৃহস্পতিবার কোষাধ্যক্ষ আনোয়ারুল ইসলামের অনেক অনুরোধের পর সাংবাদিকরা শিক্ষার্থীদের অনুরোধ করেন ২ মিনিট শিক্ষকদের কথা বলার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। অবশেষে শিক্ষার্থীরা তাদেরকে ২ মিনিট কথা বলার সুযোগ করে দেন।

এ সময় কোষাধ্যক্ষ বলেন, আমরা তোমাদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। রোববারের ঘটনায় কে বা কারা জড়িত সেটা আগে তদন্ত করার জন্য আমাদেরকে সুযোগটা দাও। তদন্তের মাধ্যমে আমরা দেখাতে চাই এই ক্যাম্পাসে যারা আসবে তারা যেন শিক্ষার্থীবান্ধব হয়।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তখন শর্ত দেন, আপনারা আমাদের সাথে সংহতি প্রকাশ করুন, নয়তো আর কোনো বিষয় আমরা শুনবো না। আমরা এক দফা দাবিতে অনড় আছি।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থী মোহাইমিনুল বাশার সংহতি প্রকাশের কথা উল্লেখ করে শিক্ষকদের উদ্দেশে বলেন, উপাচার্যের কাছে তার চেয়ারটাই আগে বড় বলে মনে হচ্ছে। এতগুলো শিক্ষার্থীরা না খেয়ে না ঘুমিয়ে, পুলিশ দ্বারা হামলার শিকার হয়ে অনবরত আন্দোলন করে যাচ্ছে। কিন্তু ভিসির চেয়ার যে অনেক উচ্চমানের! তাই তিনি ছাড়তে পারছেন না। আমরা অবিলম্বে এই ভিসির পতন চাই। তার অধীনে আমরা থাকতে চাই না।

তিনি শিক্ষকদেরকে আরও বলেন, বিভাগের শিক্ষকরা মুঠোফোনে শিক্ষার্থীদের হুমকি দিচ্ছেন ভিসির পদত্যাগের আন্দোলন থেকে সরে যাওয়ার জন্য।
বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ২০ মিনিটে কোষাধ্যক্ষের কাছে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোষাধ্যক্ষ বলেন, শিক্ষকরা চাইছেন তাদের সাথে আলোচনার ক্ষেত্র তৈরির করতে। এজন্য শিক্ষকরা বিভিন্নভাবে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। শিক্ষক দ্বারা শিক্ষার্থী হুমকির বিষয়টি বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩শ শিক্ষার্থীর ওপর পুলিশের মামলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি তাদের ওপর যেন কোনো মামলা না হয়। এমনকি প্রশাসনের উপর মহল থেকেও শিক্ষার্থীদের ওপর কোনো মামলা যেন না করা হয় সে বিষয়ে আমরা লক্ষ্য রাখছি। এছাড়া সরকার থেকেও এ বিষয়ে বলা হচ্ছে।

ভিসির অধীনে শিক্ষার্থীরা থাকতে চাইছেন না- এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সবকিছুর একটা নিয়ম-কানুন আছে। নিয়মের ভেতর দিয়েই যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে আইন-কানুন আছে সে অনুযায়ীই আমাদেরকে আগাতে হবে।

পুলিশের হামলার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা তদন্তের বিষয়। এটার জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের কাছে বার বার আসছি। কে বা কাদের আদেশে হামলা হয়েছে সেটা তদন্ত না করলে বের হবে না। যদি ভিসির আদেশের হামলা হয়ে থাকে বা প্রক্টর বা ছাত্র উপদেষ্টা বা কোষাধ্যক্ষ বা সরকারের বা পুলিশের উপর মহল থেকে হামলার আদেশ হয়ে থাকলে সেটা তদন্ত করতে হবে।

এদিকে অনশনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫ জন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারং বিভাগের শিক্ষার্থী কাজল দাশকে সিলেটের রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। অনশনরত আরও একজন শিক্ষার্থীকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এছাড়া অনশনরত শিক্ষার্থী জান্নাতুল নাঈম নিশাতসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ৩ জনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া বিবৃতি সম্পর্কে প্রেস ব্রিফিং করেন লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিসা আনজুম ও সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মারুফ। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয় চলমান ঘটনায় প্রশাসনের বিবৃতিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

অনশনরত শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী নাফিসা আনজুম বলেন, অনশনরত ২৪ জনের মধ্যে অনেকেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আমরা পর্যাপ্ত মেডিকেল সাপোর্ট পাচ্ছি না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকেও আমদেরকে কোনো মেডিকেল সাপোর্ট দেওয়া হচ্ছে না। আমরা অনুরোধ করছি, সিলেটে অবস্থানরত ডাক্তাররা শিক্ষার্থীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিন। আমাদেরকে মেডিকেল সাপোর্ট দিয়ে সাহায্য করুন।
 

Link copied!