পাবনা শহরের আব্দুল হামিদ সড়কের সাংস্কৃতিক চত্বরে সোমবার দুপুর বারোটায় বসে চা পান করছিলেন শহরতলীর বালিয়াহালট এলাকার মাঝ বয়সী রিকশা চালক মোফাজ্জল হোসেন। তার সঙ্গেই বসে ছিলেন ট্রাক শ্রমিক আব্দুল করিম। জুট ব্যবসায়ী লিয়াকত আলী। সদ্য সমাপ্ত পাবনা সদর উপজেলার ৯ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদের নির্বাচনী ফলাফল নিয়ে তারা বেশ সমালোচনার ঝড় তুলেছেন।
তারা বলছিলেন, এহন ক্যাম্বা লাগে দেহো। টেহা দিয়ে টিকিট লিয়ে আসি তিন নাম্বারও হবের পারো না। সব দোষ এমপির। কেম্বা সব লোক দেছে যে ভোটারের কাছে যাবির পারেন না, ভোট চাবির পারে না। ইলেকশনে পাস দিবের পারে না। তারা হবের পারেনি এডাতো এমপির পাড়ই যায়। নিজির আসনে এম্বা করি ডুবি দিবি এডাকি মানি লিবির পারবিনি শেখের বেটি।
রোববার চতুর্থ দফায় সারাদেশের ন্যায় পাবনার ৩ উপজেলার ১৮টি ইউনিয়নের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওইদিন রাতেই নির্বাচিতদের নাম ঘোষণা করা হয়। নাম ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ভরাডুবিতে নিজ দলের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সচেতন মহলে বেশ ঝড় উঠেছে। চারিদিকেই কানাঘুষা চলছে ক্ষমতায় থেকেও ভরাডুবিতে।
পাবনা সদর, আটঘরিয়া ও ভাঙ্গুড়ার নির্বাচনী এলাকা ঘুরে, সাধারণ মানুষ, তৃণমূলের নেতাকর্মী, সচেতন মহলসহ সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, কেন্দ্র কিন্তু স্থানীয় নেতাকর্মীদের খুব কম জানেন এবং বোঝেন তাদের সম্পর্কে। উপজেলা ও জেলা কমিটি থেকেই মনোনয়ন দেওয়ার জন্য কেন্দ্রে নাম প্রস্তাব করা হয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের দেখে দেখে। অথচ এবার উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের নেতারা নিজেদের আখের গোছাতে জনসমর্থনহীন, রাজনীতিতে অদক্ষ, অযোগ্য, নেতাকর্মীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, বিতর্কিতসহ নানা অভিযোগে অভিযুক্ত লোকদের কাছে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মনোনয়ন বাণিজ্য করেছে।
তারা বলেন, যাদের রাতের আঁধারে অবৈধ পন্থায় কেন্দ্রের মনোনয়ন বোর্ডকে ম্যানেজ করে মনোনয়ন পাইয়ে দিয়েছেন। সেই সকল মনোনীত ব্যক্তিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ মানুষ তথা ভোটারদের কাছে যেতে পারেননি। অনেকেই নৌকা প্রতীক পাওয়া মানে চেয়ার পাওয়ার মতোই নিজেকে ভেবে নিয়ে ভোটারদের কাছে যাওয়ার প্রয়োজনও মনে করেননি। তাদের দাবী, ত্যাগী, দলের জন্য পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের না দিলে নিজ দলসহ অন্যান্য দল ও গোষ্ঠী এটাকে পুঁজি করে নির্বাচনী মাঠ উত্তপ্ত করায় নৌকা প্রতীকের এই বিপর্যয়।
স্থানীয় পর্যায়ে রাজনীতি নিয়ে চিন্তাভাবনাকারী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে আলাপকালে তারা বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের ঘোলা রাজনীতির কারণে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব, ক্ষমতার লোভ, আর্থিক সুবিধা আদায়সহ নানা বিষয় প্রকাশ্য চলে আসে। ওই সকল কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল। স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃবৃন্দের সুপারিশের পরও কেন্দ্রীয় ভাবে খোঁজ খবর নেয়াটাও দলের নীতিনির্ধারকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হতাশাজনক এই নৌকার ভরাডুবিটা যেমন স্থানীয় রাজনীতি পর্যায়ে অশনি সংকেত। তেমনি আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাবও পড়তে পারে। সেই লক্ষ থেকে এখনই সাংগঠনিক দুর্বলতা কাটিয়ে নতুনভাবে নতুন আঙ্গিকে দলকে শক্তিশালী করতে তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা জরুরি।
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য মতে, পাবনা সদরের দোগাছিতে বর্তমান চেয়ারম্যান আলী হাসান বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে ধরাশায়ী করেন। ঘোড়া ১২ হাজার ৫৭৬ ভোট পেলেও নৌকা পায় ৯ হাজার ৫৭ ভোট। গয়েশপুরে বিদ্রোহী প্রার্থী মোতাহার হোসেন মোতাই পান ১২ হাজার ৭৭৭ ভোট। আর নৌকা পায় ৬২৯ ভোট। হিমাইতপুরে জামায়াত সমর্থিত জাহাঙ্গীর আলম খান পান ১২ হাজার ৮৩৪ ভোট। আর নৌকা পায় ৯ হাজার ৮৪৯ ভোট। দাপুনিয়াতে বিএনপি সমর্থিত ওমর ফারুক ভোট পান ১২ হাজার ৪২৪ ভোট। আর নৌকা পায় ৮ হাজার ৫১৩ ভোট। মালিগাছা ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ মুনতাজ আলী পান ১০ হাজার ৫৫৭৫ ভোট। নৌকা পায় ৮ হাজার ৩৮৯ ভোট। সাদুল্লাহপুরে বিএনপি সমর্থিত আব্দুল আলীম মোল্লা পান ৭ হাজার ৪৭৪ ভোট। আর নৌকা পায় ৬ হাজার ৯৩১ ভোট। মালঞ্চি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী কবির আহমেদ বাবু পান ৫ হাজার ৩৯৬ ভোট। আর নৌকা ২ হাজার ৪৬৪ ভোট। আতাইকুলায় বিএনপি সমর্থিত শওকত হোসেন পেয়েছেন ৮ হাজার ৪৩১ ভোট। আর নৌকা পেয়েছে ৫ হাজার ২৭৬ ভোট।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাবনা সদরের অধিকাংশ ইউনিয়নের ভোট কেন্দ্রগুলোতে স্থানীয় নেতাদের দায়িত্ব থাকলেও অধিকাংশ কেন্দ্রেই দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানসহ হতাশাজনক ভোট প্রাপ্তিতে সচেতন মহলে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিষয়টি ত্যাগী ও দলের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীরাও মেনে নিতে পারছেন না। একই দলের একাধিক প্রার্থী স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী রূপে অবস্থান নেওয়ায় দলীয় প্রতীকে ভোট কম পড়েছে বলে দাবী স্থানীয় নেতাদের। ত্যাগী নেতাদের অভিযোগ, যারা দল করেন, দলকে ভালোবাসেন। দলের প্রতীককে সম্মান জানান। তারা কখনো দল মনোনীত ব্যক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু হতাশাজনক ভোটপ্রাপ্তিই বলে দিচ্ছে মনোনীত ব্যক্তি ও স্থানীয় নেতাদের অবহেলা, মনোমালিন্য, ভেতরে ভেতরে দ্বন্দ্ব পুষে রাখাই দলের জন্য ক্ষতির কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) পাবনা জেলা শাখার সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক আব্দুল মতীন খাঁন বলেন, “ক্ষমতার দ্বন্দ্ব অন্যতম কারণ। সবাই ক্ষমতা হাতে পেতে চায়। আর বিদ্রোহী প্রার্থীরাও ফ্যাক্টর ছিল। তারা একই দলের প্রভাবশালী নেতা। প্রার্থী বাছাইয়ে তেমন ভুল ছিল না। সব ইউনিয়নে ত্যাগী ও অভিজ্ঞ নেতাদের মনোনয়ন দিয়েছিল। এখানে মনোনয়ন বাণিজ্য তেমন একটা হয়নি। তবে মনোনয়ন পাওয়া ওই সব যোগ্য প্রার্থীর টাকা ও পেশীশক্তি ছিল না। জেলার নেতারা দিনে একজনের আর রাতে আরেকজনের পক্ষে কাজ করেছে। এসব মিলিয়ে নৌকার পরাজয় হয়েছে।”
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রেজাউল রহিম লাল বলেন, “সদর উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের সবকটিতে নৌকার পরাজয় নিয়ে আমরা নিজেরাও স্তম্ভিত। কেন এই পরাজয় সেটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে এর কারণ খতিয়ে দেখা হবে। প্রার্থী বাছাইয়ে কোন ভুল ছিল না বলে মনে করি। জেলা আওয়ামী লীগের পরবর্তী সভায় পরাজয়ের কারণ চিহ্নিত করা হবে। এর বেশি কিছু আপাতত বলতে পারছি না।“
পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হাসান শাহীন বলেন, “পরাজয়ের একাধিক কারণ আছে। এখানে কোনো মনোনয়ন বাণিজ্য হয়নি। তবে প্রার্থী নির্ধারণে কিছুটা ভুল ছিল। পরবর্তীতে প্রার্থীর মনোনয়ন পাবার পর আমাদের দলীয় নেতাদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। প্রার্থী নির্ধারণে আমরা একটি সাধারণ পন্থা অবলম্বন করেছিলাম, গত নির্বাচনে যারা চেয়ারম্যান ছিলেন তাদের প্রাধান্য দেয় মনোনয়ন দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছিল। কিন্তু তারা হয়তো সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যেতে পারেনি। আবার একজন নৌকা প্রতীক পেয়েছে, আর চারজন প্রার্থী তার বিরোধিতা করেছে। তাদের আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। সাংগঠনিক কিছু দুর্বলতা ছিল।”
এ বিষয়ে পাবনা সদর আসনের সংসদ সদস্য, জেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্সের মতামত জানতে ফোন দেয়া হলেও তিনি তাৎক্ষণিক কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। অবশ্য পরে তাকে আবারও ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ করেননি।