কয়েক বছর আগে আজারবাইজানের বিমান বিধ্বস্ত হয়ে ২৫ জন মানুষ মারা গিয়েছেন। এ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে পাখির সঙ্গে বিমানটির সংঘর্ষ।
২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর ১৮১ আরোহী নিয়ে বিধ্বস্ত হয় দক্ষিণ কোরিয়ার জেজু এয়ারলাইনস। বিমানটি থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকে ফিরছিল। দুর্ঘটনায় ১৭৯ জন মারা গেছেন। দুজন ক্রুকে ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ দুর্ঘটনার কারণ তদন্ত করছে। বিমানটি অবতরণের ঠিক আগে, বিমান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র থেকে বার্ড স্ট্রাইক বা পাখির আঘাতের সতর্কতা দেওয়া হয়েছিল।
তবে তদন্তের মাধ্যমেই বোঝা যাবে, পাখির আঘাতের কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে কি না, নাকি এর পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে।
পাখির আঘাত কী
পাখির আঘাত বলতে মূলত পাখির সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষকে বোঝায়। এটি বিমানের জন্য বিপজ্জনক, কারণ পাখি ইঞ্জিনে ঢুকে গেলে জেট ইঞ্জিন শক্তি হারাতে পারে।
পাখির আঘাত খুব সাধারণ একটি ঘটনা। যুক্তরাজ্যে ২০২২ সালে ১,৪০০ এর বেশি বার্ড স্ট্রাইক-এর (পাখির আঘাত) রিপোর্ট হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ১০০টি ঘটনা বিমানকে প্রভাবিত করেছে বলে জানিয়েছে দেশটির সিভিল অ্যাভিয়েশন অথরিটি।
কিউকিউ বিশ্ববিদ্যালয়ে এভিয়েশন বিষয়ের অধ্যাপক ডাগ ড্রুরি এ বছর 'দ্য কনভার্সেশন'-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখেন, বোয়িং বিমানগুলোর টারবোফ্যান ইঞ্জিন রয়েছে, যা পাখির আঘাতে গুরুতর ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
পাখির আঘাত কতটা বিপজ্জনক হতে পারে
পাখির ধাক্কা সাধারণত বিমানের মারাত্মক দুর্ঘটনার কারণ হয় না।
যদি পাখি ইঞ্জিনে ঢুকে যায়, তাহলে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে পাইলটরা সাধারণত সময়মতো বিষয়টি সামলে নিয়ে জরুরি অবতরণ করতে পারেন।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাগ ড্রুরির মতে, পাইলটরা সকালে বা সন্ধ্যায় বিশেষভাবে সতর্ক থাকেন, কারণ এই সময় পাখিরা বেশি সক্রিয় থাকে।
তবে পাখির ধাক্কায় ভয়াবহ দুর্ঘটনা অতীতে ঘটেছে।
১৯৮৮ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বিমান ও বন্যপ্রাণীর সংঘর্ষে ৭৬ জন মারা গেছে বলে ফেডারেল এভিয়েশন প্রশাসন জানিয়েছে।
উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা ঘটে ১৯৯৫ সালে আলাস্কার এক বিমান ঘাঁটির কাছে। কানাডা ও আমেরিকার ২৪ জন বিমানসেনা একটি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান। এটি একটি হাঁসের ঝাঁকের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণে হয়েছিল।
সবচেয়ে পরিচিত পাখির আঘাতের ঘটনা ঘটেছিল ২০০৯ সালে। তখন একটি এয়ারবাস বিমানের সাথে রাজহাঁসের একটি ঝাঁকের সংঘর্ষ হলে সেটি নিউইয়র্কের হাডসন নদীতে জরুরি অবতরণ করে। এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
এ ঘটনা ২০১৬ সালের 'সালি' সিনেমাতে তুলে ধরা হয়, যেখানে টম হ্যাঙ্কস পাইলট চেসলি "সালি" সুলেনবার্গারের চরিত্রে অভিনয় করেন।
খুদে এক পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে বিমান কীভাবে দুর্ঘটনায় পড়ে।
এটাকে কেউ আমাদের সমাজে প্রচলিত এক প্রবাদের সঙ্গে মেলাচ্ছেন। বিদ্রুপাত্মক সেই প্রবাদটা হলো—হাতির সঙ্গে পিঁপড়ার সংঘর্ষ।
অনেকেই ভাবতেই পারেন না, তুচ্ছ এক পাখির সঙ্গে বিশাল ওজনের বিমানের কিভাবে সংঘর্ষ হয়। আর যদি হয়ও, এতে বিমানের ক্ষতি কীভাবে হয়?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের সংঘর্ষে বড় ধরনের ক্ষতি হয় না।
তবে কখনো কখনো এ ধরনের পরিস্থিতি মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ কীভাবে ঘটে
বিমান যখন টেকঅফ (উড্ডয়ন) বা ল্যান্ডিং (অবতরণ) করে, তখন এটি ভূমির কাছাকাছি অবস্থায় থাকে। এ সময় বিমান পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কারণ অনেক পাখি মাটির কাছাকাছি উড়ে বেড়ায়।
সাধারণত বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় খাবার বা আশ্রয়ের জন্য পাখির আনাগোনা বেশি থাকে। ফলে সংঘর্ষের আশঙ্কা অনে বেশি থাকে।
পাখি যদি উড়ন্ত বিমানের জেট ইঞ্জিনে ঢুকে যায়, ইঞ্জিনে মারাত্মক সমস্যা তৈরি হতে পারে। ইঞ্জিন থেমে যেতে পারে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আগুন ধরে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ২০০৯ সালের ‘মিরাকল অন দ্য হাডসন’ দুর্ঘটনায় এমন ঘটনা ঘটেছিল।
সেই ঘটনায় একটি বিমান পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের পর নদীতে জরুরি অবতরণ করে।
পাখি অনেক সময় অজান্তে বিমানের নাক বা ককপিটের উইন্ডশিল্ডে আঘাত করে। এতে বিমানের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটতে পারে। এমনকি ককপিট ক্রুদের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
পাখি বিমানের ডানায় বা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশে আঘাত করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে বিমানের উড্ডয়নক্ষমতায় ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। এটা বিমানের ভারসাম্য এবং নিয়ন্ত্রণে সমস্যা তৈরি করে।
কেন পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ ঝুঁকিপূর্ণ
পাখির ওজন এবং বিমানের গতির কারণে সংঘর্ষের সময় যে শক্তি উৎপন্ন হয়, তা মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, একটি ১ কেজি ওজনের পাখি যদি ঘণ্টায় ৩২০ কিলোমিটার গতির বিমানের সঙ্গে সংঘর্ষ করে, তা একটি বড় বিস্ফোরণের শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।
কিছু সময় একসঙ্গে অনেক পাখি বিমানের সঙ্গে ধাক্কা খেতে পারে। এতে বিমানের একাধিক অংশে ক্ষতি তৈরি করে।
এ জন্য বিমানবন্দরগুলো পাখির সঙ্গে সংঘর্ষ প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়। যেমন অনেক বিমান বন্দরে ব্যবহার করা হয় পাখি তাড়ানোর প্রযুক্তি। বিমানবন্দরগুলোতে শব্দ সৃষ্টিকারী ডিভাইস বা লেজার লাইট ব্যবহার করে পাখি তাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
বিমানবন্দরের আশপাশে পাখির খাবার এবং আশ্রয়ের সম্ভাবনা কমাতে জলাধার এবং গাছপালা সরিয়ে ফেলা হয়। আধুনিক রাডার সিস্টেম ব্যবহার করে পাখির অবস্থান শনাক্ত করা হয় এবং বিমানের পাইলটকে সতর্ক করা হয়। এ ছাড়া, বিমানবন্দরের আশপাশে এমন অবস্থা তৈরি করা হয় যাতে পাখি সহজে সেখানে আকৃষ্ট না হয়।
পাখির সঙ্গে বিমানের সংঘর্ষ বিমান চলাচলের একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ, তবে আধুনিক প্রযুক্তি এবং কার্যকর ব্যবস্থার মাধ্যমে এই সমস্যাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। গবেষণা ও উন্নয়নের ফলে এখন বিমানবন্দরগুলো আরও নিরাপদ হচ্ছে, এবং পাইলটরা এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রশিক্ষিত।
তবু এ ধরনের ঘটনা এড়াতে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। যেমন, বিমানবন্দরের আশপাশে বর্জ্য না ফেলা, যেগুলো পাখি আকর্ষণ করতে পারে। এ ছাড়া, সাধারণ মানুষকেও এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি।
এ সমস্যা সমাধানে মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের একটি টেকসই সমাধান প্রয়োজন। বিজ্ঞানীরা আরো উন্নত প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি উদ্ভাবনে কাজ করছেন। সেগুলো হয়তো ভবিষ্যতে এই সমস্যার ঝুঁকি প্রায় শূন্যে নামিয়ে আনবে। এই উন্নয়ন বিমান চলাচলের নিরাপত্তা এবং বিশ্বব্যাপী পরিবহন ব্যবস্থায় একটি নতুন দিগন্তের সূচনা করবে।
সূত্র : হাউ ইটস ওয়ার্কস