ট্রাম্পের শুল্ক দেশের রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য সংকট

সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক প্রকাশিত: জুলাই ৯, ২০২৫, ১১:৪৬ এএম
ছবি: সংগৃহীত

যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর নতুন করে ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। আগামী মাস থেকে এই নতুন হার কার্যকর হবে। দেশের রপ্তানি খাতের জন্য সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে শুল্ককে। 

শুল্ক কমাতে ওয়াশিংটনে উচ্চ পর্যায়ের দর-কষাকষি শুরু করেছে ঢাকা। এর আগে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছিলেন ট্রাম্প। এই দফায় সেখান থেকে সামান্য শুল্ক কমলেও তৈরি পোশাকের বাণিজ্যে আঞ্চলিক প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এটা বেশি।

এই উচ্চ শুল্কের কারণে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২০ শতাংশ শুল্কের সুবিধা পেয়েছে। ফলে ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশকে ১৫ শতাংশ বেশি শুল্ক দিতে হবে। এতে মার্কিন ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশি পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে, যা রপ্তানিকারকদের জন্য একটি বড় দুঃসংবাদ।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করার সময়সীমা ১ আগস্ট পর্যন্ত বেঁধে দিয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে চুক্তি না হলে বিভিন্ন দেশের পণ্যের ওপর ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানোর হুমকি দিয়েছেন তিনি।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ১৪ জন সরকারপ্রধানের কাছে পাঠানো চিঠিতে তিনি এই বার্তা দেন।

প্রধান উপদেষ্টাকে লেখা চিঠিতে ট্রাম্প আরও লিখেছেন, যদি আপনারা নিজেদের শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন, তবে আপনারা যে হার বাড়াবেন, আমাদের ধার্য করা ৩৫ শতাংশের সঙ্গে সেই হারও যোগ করা হবে।'

নতুন এই মার্কিন শুল্ক বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর 'ত্রিমুখী চাপ' তৈরি করেছে। একদিকে প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য সমস্যা, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরীণ জ্বালানি সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়া—এই দুই সংকটের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এই উচ্চ শুল্ক।

অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদ মাধ্যম ব্লুমবার্গ বলছে, এই তিন সংকটের মিলিত প্রভাবে শুধু ২০২৫ সালেই বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি দুই বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত কমে যেতে পারে। দেশের মোট রপ্তানির ৮১ শতাংশই আসে তৈরি পোশাক খাত থেকে। তাই এই ক্ষতি পুরো অর্থনীতির জন্য একটি বড় আঘাত।

এই সংকট মোকাবিলায় জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ। বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান ইতোমধ্যে ওয়াশিংটনে পৌঁছেছে। ১০ ও ১১ জুলাই তারা মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন। সেখানে আরও আছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা এস কে বশির উদ্দিন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।

আলোচনায় বাংলাদেশের মূল যুক্তি হবে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) হিসেবে বিশেষ শুল্ক সুবিধা পাওয়া। বাণিজ্যসচিব আশা প্রকাশ করে বলেন, 'এলডিসিগুলোর জন্য ট্রাম্প প্রশাসন একটি পৃথক শুল্ক ব্যবস্থা করার কথা ভাবছে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের জন্য শুল্কের হার ১০ শতাংশ হওয়া উচিত।'

তিনি আরও বলেন, সেই সুবিধা না পেলেও বাংলাদেশের শুল্কহার তুলনামূলক উন্নত দেশ ভিয়েতনামের ২০ শতাংশের চেয়ে অনেকটাই কম হতে হবে।

ছয় বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ও দর-কষাকষিতে সুবিধা পেতে বাংলাদেশ কিছু ছাড় দেওয়ার প্রস্তাবও তৈরি রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম, তুলা, এলএনজি ও সয়াবিনের মতো পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা। এর বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তাদের তৈরি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সরঞ্জাম কেনার অনুরোধ জানিয়েছে।

সরকারের তৎপরতা সত্ত্বেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি এখনো বেশ অনিশ্চিত।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‍্যাপিডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এর আসল প্রভাব কী হবে, তা নির্ভর করছে আমাদের প্রতিযোগী দেশ, বিশেষ করে চীন ও ভারতের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কেমন শুল্ক আরোপ করে, তার ওপর। যদি চীনের ওপর উচ্চ হারে শুল্ক বসে, তবে অনেক ক্রয়াদেশ বাংলাদেশে চলে আসতে পারে, যা আমাদের জন্য লাভজনক হবে।'

তবে পোশাক খাতের নেতারা গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, যেসব কারখানা তাদের উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, মার্কিন বাজার হারালে রপ্তানিকারকরা ইউরোপের মতো অন্যান্য বাজারে ভিড় করবে। এতে নিজেদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হবে এবং বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম কমানোর সুযোগ নেবে।

অবশ্য শীর্ষ রপ্তানিকারকদের কেউ কেউ বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান এ. কে. আজাদ মনে করেন, ৩৫ শতাংশ শুল্ক চূড়ান্ত নয়, বরং এটি আলোচনার একটি কৌশল মাত্র। তিনি বলেন, আমি বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমে এই হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।