এক বছরে কর্তন ১৭০০, তিন বছরে রোপন একটিও নয়

নয়ন দাস, শরীয়তপুর প্রকাশিত: এপ্রিল ২৭, ২০২৪, ০৪:২০ পিএম

শরীয়তপুরে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁই ছুঁই। তীব্র তাপদাহের কারণে মানুষ ছটফট করছে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে।  এমন সময় সরকার বৃক্ষরোপণ করতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করছে। তবে গত এক বছরে শরীয়তপুরে এক হাজার ৭০০ গাছ কাটলেও তিন বছরে মধ্যে একটিও রোপন করেনি বন বিভাগ।

পদ্মা, মেঘনাবেষ্টিত শরীয়তপুর এক সময় ছিল সবুজ শ্যামল ছায়া সুনিবিড় একটি জেলা। কিন্তু প্রতি বছর কারণে-অকারণে গাছ কাটা হলেও নতুন করে গাছ রোপন না করায় দেশের অন্যান্য জেলার মতো শরীয়তপুরেও চলছে তাপপ্রবাহ। অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষসহ প্রাণিকূল।

সরেজমিনে জেলার বিভিন্ন সড়কে ঘুরে দেখা যায়, তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেও কাটার জন্য নতুন করে চিহ্নিত করা হয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ।

[85219]

জেলার বন বিভাগ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরে শরীয়তপুরের ছয়টি উপজেলার বিভিন্ন সড়কের ১৯ কিলোমিটার অংশে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় এক হাজার ৭০০ গাছ টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করেছে বন বিভাগ। এর মধ্যে ভেদরগঞ্জ উপজেলার পুরাতন মোল্লার বাজার থেকে বাংলা বাজার পর্যন্ত ১ কিলোমিটার, চরপায়াতলি থেকে হাকিম আলী ব্রিজ পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, সদর উপজেলার বাংলা বাজার (আমিন বাজার) থেকে ঘোড়ার ঘাট পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার, আটং ডিসি রোড থেকে পম লাকার্তা পর্যন্ত ৫ কিলোমিটার, ডামুড্যা উপজেলার  স্বনির্ভর থেকে কুতুবপুর পর্যন্ত ৩ কিলোমিটার, গোসাইরহাট উপজেলার দপ্তরি বাড়ি থেকে মলংচরা পর্যন্ত ১ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে।

এছাড়াও আরও গাছ কাটার জন্য জেলার বিভিন্ন সড়কের গাছে চিহ্ন দিয়ে রাখা হয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটার কারণে এসব সড়কে বেড়েছে রোদের তীব্রতা। সড়কে চলাচলকারী পথচারীসহ সড়কের দুই পাশের মাঠে কৃষি কাজ, মাটি কাটাসহ বিভিন্ন কাজ করতে গিয়ে হাঁপিয়ে পড়ছেন শ্রমিকরা। তীব্র এই গরমে কোথাও গাছের নিচে বসার সুযোগ নেই।

এভাবেই গত তিন অর্থ বছরে উন্নয়ন প্রকল্পের নাম ব্যবহার করে জেলার সড়কগুলোর শত বর্ষী বিভিন্ন গাছসহ কয়েক হাজার গাছ কাটা হলেও একটি গাছও রোপন করেনি বন বিভাগ। সরকারি এই সংস্থাটি জানিয়েছে সর্বশেষ ২০২১ সালে বৃক্ষরোপন করা হয়েছিল।

জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, শরীয়তপুর জেলা কৃষিনির্ভর একটি জেলা। এক সময় অধিকাংশ জমির চাষাবাদ খাল ও নদীর পানি থেকে হলেও প্রতিনিয়ত বৃষ্টিপাত কম হওয়ার কারণে কৃষকরা সেচনির্ভর হয়ে পড়ছে। বর্তমানে জেলার কৃষি জমির পরিমাণ ১ লাখ ১৮ হাজার ২৩৪ হেক্টর জমি। এর মধ্যে চাষাবাদ যোগ্য ৮২ হাজার ২৭৬ হেক্টর জমি। চাষাবাদ যোগ্য এই জমির শতকরা ৪০ ভাগ সেচের ব্যবস্থা হয় খাল ও নদীর পানি থেকে। বাকি ৬০ ভাগ জমির চাষাবাদ গভীর নলকূপ থেকে সেচনির্ভর হয়ে পড়েছে।

[85042]

জেলা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ কৃষি জমির দুই পাশের সড়কে কোনো গাছ নেই। যেগুলো ছিল তা কেটে নিয়েছে বন বিভাগ। গ্রাম ও শহর অঞ্চলের হাটবাজারেও নেই গাছ। গাছ কাটার কারণে এক সময়কার ছায়া সুনিবিড় শরীয়তপুর জেলা তপ্ত হয়ে উঠেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নতুন বাড়ি নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্পের নামে বন বিভাগের গাছ কাটার কারণেই এমন অবস্থা হয়েছে বলে মনে করছে সচেতন মহল।

ডামুড্যা এলাকার আমিনুল হক বলেন, “গাছের অপর নাম জীবন। কিন্তু বন বিভাগ প্রতিবছর গাছ কাটলেও একটিও রোপন করছে না। আমরাও বিভিন্ন প্রয়োজনে গাছ কাটছি। এভাবে অপরিকল্পিতভাবে গাছ কেটে ফেলার কারণে বৃষ্টি হচ্ছে না, গরম অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বন বিভাগ ও আমাদের সবার উচিত আগে গাছের চারা রোপন করে ওই চারার জীবন নিশ্চিত করা, তারপর গাছ কাটা।”

আব্দুল আলী পেশায় একজন কৃষক। সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম। কিন্তু সড়কের দুই পাশে তাকিয়ে দেখুন কোনো গাছ নেই। সব গাছ কেটে উজাড় করে ফেলা হয়েছে। এই গরমে মাঠে ধান কাটতে যেতে সাহস হয় না। তবুও জীবীকার তাগিদে যেতে হবে। কিন্তু তপ্ত রোদের তাপে ক্লান্ত হয়ে পড়লে গাছের নিচে বসে একটু জিরিয়ে নেওয়ার উপায় নেই। বৃষ্টি না হওয়ার কারণে গভীর নলকূপ থেকে পানি সেচ দিয়ে চাষাবাদ করতে হয়। এভাবে চলতে থাকলে বাঁচা সম্ভব হবে না।”

[85788]

নূর মোহাম্মদ সরদার নামের গোসাইরহাটের আরেক কৃষক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমার বয়স প্রায় ৭০ বছর। জীবনেও এত গরম আমি দেখিনি। গাছ ছায়া দেয়, বাতাস দেয়। কিন্তু আমরা গাছ কাটি, বন বিভাগও গাছ কাটে। এভাবে গাছ কাটতে থাকলে তো গরম আরও তীব্র হবে। বন বিভাগ যে গাছ কেটেছে, সেই পরিমাণ গাছ রোপন করার অনুরোধ রইলো।”

বন বিভাগের গাছ কাটার বিষয়য়ে অ্যাড. মোদাচ্ছের হোসেন বাবুল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সারা দেশের সঙ্গে শরীয়তপুরের তাপমাত্রাও অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। বন বিভাগ গাছ রক্ষা করে যেখানে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করবে, সেখানে তারা বছরের পর বছর গাছ কেটেই যাচ্ছে। কিন্তু গাছের চারা রোপনের নাম গন্ধও দেখতে পাচ্ছি না। এভাবে চলতে থাকলে জলবায়ু আরও পরিবর্তন হবে। প্রাণিকূল জীবন সঙ্কটে পড়বে। বন বিভাগ গাছ কাটলে নিয়ম অনুযায়ী গাছ রোপন করার কথা। কিন্তু সেটা তারা না করে শরীয়তপুরের পরিবেশকে এভাবে অসহনীয় করে তুলেছে। বিষয়টি চিন্তার ও উদ্বেগজনক।”

শরীয়তপুরের বন বিভাগের বন কর্মকর্তা মো. সালাহ উদ্দিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “চলতি অর্থ বছরে দারিদ্র্য বিমোচন প্রকল্পের আওতায় ১৯ কিলোমিটার সড়কের ১ হাজার ৭০০ গাছ কাটা হয়েছে। গাছের বয়স ১০ বছর হলেই আমরা গাছ কেটে ফেলি। সর্বশেষ ২০২১ সালে বৃক্ষরোপন করা হয়েছে জেলায়। চুক্তি ও শর্ত অনুযায়ী আমরা আগামীতে বৃক্ষরোপন করব।”

এ ব্যাপারে শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে সেই বিষয়টি দেখছি।“ নতুন করে গাছ লাগাবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আপাতত আমরা কাজ চালাচ্ছি পরে জানাব।”